icon/64x64/pollution দূষন

ভারত আর চীনের দূষণ এখন পৌছে যাচ্ছে বায়ুমন্ডলের ষ্ট্রাটোষ্ফিয়ার স্তরে

মৌসুমী ঝড়ের প্রাবল্যে ভারত ও চীনে সৃষ্ট দূষণ হিমালয় ছাড়িয়ে স্ট্রাটোষ্ফিয়ারে ছড়িয়ে পড়ছে, বাড়ছে বৈশ্বিক উঞ্চতা

Smog over northern India [image by NASA]

চীন ও ভারতে সৃষ্ট দূষণ কেবল বাড়ছেই না, বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়ছে ব্যাপকভাবে। বিজ্ঞানীদের মতে দক্ষিণ এশিয়ার উঞ্চ মৌসুমী বায়ুপ্রবাহের কারনেই এমনটি ঘটছে।

এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমী আবহাওয়া ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। দূষিত অ্যারোসোল (ধূলিকণা), জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানো এবং কিছু ক্ষেত্রে অন্যান্য জৈব বস্তুপুঞ্জ ব্যাপক ভিত্তিতে সুর্যের আলো ধারণ করে, যার ফলে ক্রমাগত বাড়ছে বৈশ্বিক উঞ্চতা।

চলতি বছর নভেম্বর মাসে ক্লাইমেট ডিনামিক্স শীর্ষক একটি জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এই অঞ্চলের মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের উপরে মারাত্বক প্রভাব ফেলছে এই ক্ষতিকর অ্যারোসোল। বিজ্ঞানীরা বলছেন হিমালয়ে জটিল ও স্উূচ্চ ভূ-সংস্থানের কারণে বায়ুমন্ডলে আবর্জণাযুক্ত অ্যারোসোলের ঘন স্তর সৃষ্টি হচ্ছে। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে এগুলো আরব অঞ্চলের মুরুভূমি থেকে আরব সাগর পাড়ি দিয়ে হিমালয়ের উপরে বায়ুস্তরে প্রতিনিয়ত জমা হচ্ছে। আর এর ফলে এই অঞ্চলে স্বাভাবিক সময়ের আগেই মৌসুমী বৃষ্টিপাত শুরু হচ্ছে।

গবেষণার এই ফলাফলটি কেবলমাত্র জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয় বরং মনে করা হচ্ছে এই গবেষণার মাধ্যমে এশিয়ার মৌসুমী ঋতুর ভবিষ্যত সম্পর্কে আরো সুস্পষ্টভাবে ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সাইন্স ইন্টারডিসিপ্লিনারি সেন্টারের বিজ্ঞানী উইলিয়াম লাউয়ের তত্বাবধানে একদল গবেষক ২০০৮ সালে ভারতে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের উপরে গবেষণা পরিচালনা করেন। গবেষণায় বলা হয়, এবছর স্বাভাবিকের তুলনায় আরব সাগর  ও উত্তর-মধ্য ভারত অঞ্চলে ধূলিযুক্ত অ্যারোসোলের প্রাবল্য দেখা গেছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও উত্তর হিমালয়ের পাদদেশে প্রবল বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যার ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে দেখা যায় দেখা যায় খরা।

নাসা উদ্ভাবিত মডেল ব্যবহার করে এই গবেষণা পরিচালনাকারী দলটি এই উপসংহারে পৌছেছে যে বায়ুতে দূষিত অ্যারোসোলের প্রভাবে এখানকার মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ক্ষেত্রে ব্যাপক-ভিত্তিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। এর ফলে বায়ুমন্ডলের ষ্ট্রাটোষ্ফিয়ার স্তরের উত্তর ও দক্ষিণ অংশে তাপমাত্রা পরিবর্তন ঘটে। এতে মৌসুমী বৃষ্টিপাত উত্তর অভিমুখে ধাবিত হয়, যার ফলে এক থেকে পাঁচ দিন এগিয়ে আসে মৌসুমী ঋতু প্রবাহ।

ষ্ট্রাটোষ্ফিয়ার স্তরে দূষণ

এদিকে অন্য এক দল বিজ্ঞানীদের মতে দূষিত অ্যারোসোল বায়ুমন্ডলের স্ট্রাটোষ্ফিয়ার স্তরের সর্বেচ্চ ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে যা মূলত ট্রপোষ্ফিয়ার স্তরের ঠিক উপরে অবস্থান করে যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের যাবতীয় ওজোন ধারণ করে। ২০০৬ সালে মহাকাশে প্রেরিত ফ্রান্স-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ ভূ-উপগ্রহ ক্যালিপসো’র (সিএএলআইপিএসও) তথ্য মতে বায়ুমন্ডলে একটি অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সেখানে তাপ বিকিরণ হয় (হিট পাম্পের মতো) যা আসলে বাযুস্তরে ধূলিকণাযুক্ত অ্যারোসোলকে বহন করে নিয়ে যায় হিমালয়ের উপরে ১৫ – ১৮ কিলোমিটার উচ্চতায় যেটি এমন একটি স্তর যা ঠিক ট্রপোষ্ফিয়ার (০ – ১৬ কিলোমিটার) ও স্ট্রাটোষ্ফিয়ার (১৬ – ৫০ কিলোমিটার) স্তরের মধ্য সীমানা। মহাকাশের এই স্তরটিকে আবার এশিয়ার ট্রপোপজ অ্যারোসোল লেয়ার (এটিএএল) হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

হিমালয়ের উপরে বায়ুমন্ডলে যে উত্তপ্ত বায়ু এবং দূষণ গিয়ে জমাট হচ্ছে এ ধরনের ধারণাটি প্রথম ২০০৬ সালে গবেষক লাউয়ের নেতৃত্বে থাকা দলটি প্রথমবারের মতো আলোচনায় নিয়ে আসে। লাউয়ের গবেষণা অনুযায়ি প্রাক বর্ষা মৌসুমে (মার্চ থেকে মে) উত্তর ভারত থেকে ঝুল এবং চীন, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে প্রচুর ধূলিকণা গিয়ে জমা হয় হিমালয়ের ইন্দো-গঙ্গা অববাহিকায়। যেহেতু এই অ্যারোসোল প্রচুর পরিমানে তাপ শোষন করে, তাই এর স্তরের চারপাশের বাতাসকে উত্তপ্ত করে হিমালয়ের উপরে ১০ – ১৫ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌছে দেয়, ঠিক ‘এলিভেটেড হিট পাম্পের’ মতো কাজ করে।

উত্তপ্ত এই বায়ু ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট অপেক্ষাকৃত শীতল বায়ুকে শোষণ করে আর এর ফলেই স্বাভাবিক সময়ের আগেই বর্ষা মৌসুমের আগমন ঘটে।

এদিকে ২০০৯ সালে ভার্জিনিয়ার নাসা ল্যাংলি রিসার্চ সেন্টার একটি গবেষণা পরিচালনা করে জ্যাঁ-পল ভার্ণিয়ারের নেতৃত্বে একটি দল। এই দলটি তাদের গবেষণায় দেখতে পায় পূর্ব ভূমধ্যসাগর, উত্তর ভারত ও পশ্চিম চীনের উপরের বায়ুস্তরে ১৩ ও ১৮ কিলোমিটার উচ্চতায় একটি ঘন অ্যারোসোলের স্তর।

২০১৫ সালে এই দলটিই আরো অধিকতর গবেষণায় দেখতে পায় যে এই স্তর ১৯৯৬ সালে প্রাপ্ত ঘনত্বের চেয়ে আরো তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৬ সালে প্রথম এই ধরনের একটি স্তর ভূ-উপগ্রহের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ভার্ণিয়ারের নেতৃত্বে এই দলটিতে কাজ করছেন চীন, সুইজারল্যান্ড ও সুইডেনের গবেষকরা। পরবর্তীতে তাদের এই গবেষণা ফলাফলটি জার্ণাল অব জিওফিজিক্যাল রিসার্চ প্রকাশ করে।

ভারতের ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি’র (এনএআরএল) বিজ্ঞানীদের সহায়তায় নাসার এই দলটি ভূ-উপগ্রহ প্রাপ্ত এই তথ্যের বিশ্লেষণ করে। এক্ষেত্রে তারা ভারত ও সৌদি আরবের আকাশে গত তিন বছরে ৩০টি বেলুন পাঠিয়ে সেখান থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষন করে বলে জানা গেছে।

এই গবেষণাটির সাথে জড়িত ছিল ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ অভয় সিং। তিনি বলেন, আমরা দেখতে পেয়েছি যে এশিয়া অঞ্চলে বায়ুমন্ডলে ১৫ – ১৮ কিলোমিটার এলাকায় অ্যারোসোলের পরিমান গভীরভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের এই অঞ্চলে উত্তর ভারত ও পশ্চিম চীনে সৃষ্ট দূষণের কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে সৃষ্ট সালফার ডাই অক্সাইড বায়ুমন্ডলের স্ট্রাটোষ্ফিয়ারে পৌছে অ্যারোসোল তৈরি করছে।

গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুমে শক্তিশালী ঝড়ের কারনে বাতাস খুব সহজেই ভূ-উপরিস্থিত বায়ুমন্ডলে পৌছে যায় – এর ফলে খুব সহজেই যে কোনো দূষণ বায়ুমন্ডলের উচ্চতর স্তরে খুব সহজেই পৌছে যায়।

তিনি আরো বলেন, আমার মতে বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বাদলই দূষিত বায়ুকে বায়ুমন্ডলে পৌছে দিতে মূল ভূমিকা পালন করে। এই দূষণ কেবল তিব্বতীয় মালভূমির উপরেই ছড়িয়ে পড়ে না বরং উত্তর ভারত ও পশ্চিম চীনের উপরেও ছড়িয়ে পড়ছে।

বিশ্বব্যাপী প্রভাব

গত আগষ্টে চীনে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় নিজের সাম্প্রতিক এক গবেষণা তুলে ধরার সময় লাউ বলেন, এই অ্যারোসোল কেবলমাত্র স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য ও পরিবেশের উপরে যে প্রভাব ফেলছে তা নয়, এটি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনেও বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ট্রপোষ্ফিয়ার উপরিভাগে ও ষ্ট্রাটোষ্ফিয়ারের নিচের স্তরে।

এর অর্থ হচ্ছে বায়ু দূষণ কেবল এখানকার বর্ষা মৌসুমের আগে এবং মধ্যবর্তী সময়ে নানা ধরনের পরিবর্তনই আনছে না বরং বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধিতেও অবদান রাখছে। এটি আরো উচ্চতায় পৌছে গেলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি আমাদের বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তরকে ধ্বংস করতে পারে যা আমাদেরকে সুর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে রক্ষা করে। এর ফলে আমাদের ত্বকের ক্যান্সার, চোখের ছানি এবং দূর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মতো ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমনকি ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হতে পারে।

এ মুহুর্তে বিজ্ঞানীরা অ্যারোসোলের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার উপায় নিয়ে কাজ করছে কারণ তারা আরো মনে করে যে এটি মেঘ ও আবহাওয়ার ধরনেও ব্যাপক পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।

 

টি ভি পদ্ম দিল্লিতে কর্মরত একজন সাংবাদিক যার কাজের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে উন্নয়ন সংক্রান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা।

 

একটি মন্তব্য যোগ করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.