দূষন

পরিবেশবান্ধব ডেনিম উৎপাদনে লেজার প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছে বাংলাদেশে

অধিক জল ও রাসায়নিকের ব্যবহার এড়িয়ে পরিবেশবান্ধব ডেনিম উৎপাদনে এখন লেজার প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানীকারক কারখানাগুলো।
বাংলা
<p>Lasers are now being used to create designs instead of chemicals [image by Denim Experts Ltd]</p>

Lasers are now being used to create designs instead of chemicals [image by Denim Experts Ltd]

এ মুহুর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি নি:সন্দেহে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প। গত বছর অক্টোবর – ডিসেম্বরে দেশের মোট রপ্তানী আয়ের ৮৩ শতাংশ এসেছে এই শিল্প খাত থেকে। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশটির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ অব্যহাত রাখতে অগ্রণী ভূমিকরা রেখেছে এই শিল্প খাত। তবে ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত রাখতে এখনই এই শিল্পের প্রতি নজর দিতে হবে। আন্তর্জাতিক মানদন্ডের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এই শিল্পের আধূণীকায়ন প্রয়োজন। আর প্রয়োজনীয়তার এই বিষয়টি অনুধাবন করে এরই মধ্যে নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে শুরু করেছেন শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা।  তারই ধারাবাহিকতায় এখন ডেনিম থেকে উৎপাদিত জনপ্রিয় জিন্স পোশাক তৈরীর ক্ষেত্রে এখন রাসায়নিক উপাদান ও জলের ব্যবহার বাদ দিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে আধুনীক লেজার প্রযুক্তি!

ডেনিম কাপড় তৈরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নানা ধরনের ও আকৃতির কাপড় তৈরী এবং জনপ্রিয় ‘নীল’ জিন্স- এর (ব্লু জিন্স) জন্য সঠিক রঙ প্রস্তুত করা। এজন্য জিন্স কাপড়ে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগ করতে হয়। পাশপাশি কাপড়ে ব্যবহৃত রাসায়নিক দুর করতে জল দিয়ে প্রচুর পরিমানে পরিস্কার করতে হয়। বাংলাদেশের এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে কথা বলে জানা গেছে মোটামুটি মানের এক জোড়া নীল রঙের জিন্স উৎপাদন করতে কমপক্ষে ১০০ লিটার জলের দরকার হয়। আর যত ভালো ও উন্নত ডিজাইন করা হয় জলের ব্যবহার ততই বৃদ্ধি পায়। ভালো ডিজাইন ও উৎকৃষ্ট মানের একজোড়া জিন্স তৈরি করতে অনেক সময় ১১,০০০  লিটার জল ব্যবহৃত হয়।

তবে জল ও রাসায়নিকের পরিবর্তে আধূনীক লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার করেও উন্নত মানের জিন্স উৎপাদন করা সম্ভব বলে জানান বাংলাদেশের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড-এর স্বত্বাধীকারী মুস্তাফিজ উদ্দিন। এই প্রযুক্তিতে জিন্স পোশাক তৈরি করলে জলের ব্যবহার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হ্রাস করা যায়। বাংলাদেশে তার কারখানাতেই এই প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে বলে তিনি জানান। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো তিনি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।

জিন্স তৈরির ক্ষেত্রে রাসায়নিকের ব্যবহার সরাসরি জলের উপরেও প্রভাব ফেলে। কারন রাসায়নিক ব্যবহারের পর প্রস্তুতকৃত জিন্স থেকে রাসায়নিক দুর করতে জলের প্রয়োজন হয়। এখানেই শেষ নয়। কারখানায় ব্যবহৃত এই দূষিত জল পরিবেশের উপরে মারাত্বক প্রভাব ফেলে যা জনস্বাস্থ্য, কৃষি ও মাছের জন্য ভয়াবহ ক্ষতির কারন হয়ে দেখা দিচ্ছে।

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের এই পরিবর্তনকে আক্ষরিক অর্থেই বেশ ইতিবাচক একটি উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ডেনিম কারখানাগুলোতে রাসায়নিক ও ভূ-গর্ভস্থ্য জলের ব্যবহার হ্রাস পাবে যা এই শিল্পের জন্য বিরাট একটি সাফল্য।

পরিবেশবান্ধব ডেনিম

সাধারনত এক জোড়া জিন্সকে বিবর্ণ (ফেডেড জিন্স) করতে প্রথমে প্রচুর পরিমানে রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হয় এবং পরবর্তী ধাপে কাপড়কে রাসায়নিক মুক্ত করতে প্রচুর জল প্রয়োগ করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ। অথচ স্বয়ংক্রিয় লেজার প্রযুক্তি দিয়ে কোনো রকম রাসায়নিক ও জলের ব্যবহার ছাড়াই কয়েক মুহুর্তে এই ডিজাইন সম্পন্ন করা সম্ভব। ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড-এর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার আবু হায়ার কবির দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, এই প্রযুক্তির ব্যবহার কেবল এই সেক্টরে একটি পদ্ধতিগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি বরং এর মধ্য দিয়ে রাসায়নিক, জল ও সময়ের অনেক সাশ্রয় হবে বলে আমরা মনে করি।

নতুন এই প্রযুক্তির সূফল সম্পর্কে জানতে চাইলে দ্যথার্ডপোল.নেটকে মুস্তাফিজ বলেন, এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পন্যের গুনাগুন অক্ষুন্ন রেখে উৎপাদনের হার বাড়ানো সম্ভব। পাশাপাশি যেহেতু সময় কম লাগে তাই কর্মীদের বাড়তি কাজের চাপও কমবে। তিনি বলেন, সব কারখানাতে এই প্রযুক্তি চালু হলে কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের দূর্ঘটনার মাত্রা কমে আসবে। তার মতে, যেহেতু রাসায়নিকের ব্যবহার কম তাই রাসায়নিক সৃষ্ট বিভিন্ন দূর্ঘটনার সম্ভাবনাও অনেক কমে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের কারখানার মতো এখন দেশের অনেক কারখানাতেই এই প্রযুক্তি চালু হচ্ছে।

বাংলাদেশের আরেকটি বড় ডেনিম কারখানা হচ্ছে তুশুকা জিন্স লি.। এই প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ সুমন বলেন, আমাদের দেশের অনেক ডেনিম কারখানায় এখন এই প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

ইউরোপসহ পশ্চিমা দেশগুলোর ভোক্তা এবং ক্রেতারা এখন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারনেই বাংলাদেশের কারখানাগুলো এখন নিত্য নতুন পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করনে তিনি।

বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ি দেশের ২৬টি কারখানায় প্রতি মাসে ২৭৪ মিলিয়ন মিটার ডেনিম তৈরি হয়। বাংলাদেশ রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ি গত ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজাওে ডেনিম রপ্তানী করে বাংলাদেশ আয় করে ৪৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজার থেকে এসেছে ১.৮ বিলিয়ন ইউরো।

আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের তৃতীয় ডেনিম উৎপাদক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে চায় বাংলাদেশ। এই তালিকায় প্রথম দুই শীর্ষ দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালী। উৎপাদক হিসেবে আগামী ২০২১ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে বার্ষিক  ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও দক্ষ শ্রমিকের অভাবে এরই মধ্যে চীন থেকে এই শিল্প বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হয়েছে।

এ মুহুর্তে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা ও ক্রেতারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য পরিবেশগত ঝুঁকি নিয়ে উদ্বিগ্ন। বিষয়টি মাথায় রেখে বাংলাদেশের উৎপাদনকারীরা তাদের কারখানাতে আধুনীক প্রযুক্তি ব্যবহারের পাশাপাশি জল ও রাসায়নিকের ব্যবহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এক ধরনের বার্তা দেয়ার উদ্দেশ্যেই এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর সাবেক সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী।

বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো– এর তথ্য অনুসারে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্ববাজারে ডেনিমের বিপনন ৬৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য এটি একটি সোনালী সুযোগ। এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে স্বাভাবিকভাবেই দেশের সব কারাখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান আরো শক্ত করতে এই সেক্টরটিকে পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন দেশের সেক্টর সংশ্লিষ্টরা। এই ধারণার কথা জানান দেশের অন্যতম ডেনিম কারখানা এনভয় গ্রুপ-এর স্বত্বাধীকারী সালাম মুর্শেদী।

বাংলাদেশের ডেনিম ফ্যাক্টরিগুলোতে যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে তার মধ্য দিয়ে এই শিল্প আরো পরিবেশবান্ধব হয়ে উঠবে। এর ফলে কারখানাগুলোতে পন্যের মান বৃদ্ধির সাথে সাথে শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকি মুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হবে। আর সর্বোপরি এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভোক্তারাও সন্তুষ্ট থাকবেন।