বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলার অন্তর্গত মেঘনা নদীর বুকে জন্ম নেয়া ক্ষুদ্র এক চরের নাম রাজরাজেশ্বর (নদীতে পলি জমে চরের সৃষ্টি হয়)। ছোট্ট এই চরে প্রায় ৪৩,০০০ মানুষের বসবাস। প্রমত্তা মেঘনার তীব্র ভাঙ্গনে চরটির মানুষের এখন বেহাল অবস্থা, তারা প্রতিনিয়তই বাস করছে চরম এক ঝুঁকির মধ্যে। বছর বছর বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়ে এখানকার অসহায় মানুষগুলোকে প্রায়ই খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হয়।
চাঁদপুর বাংলাদেশের দুটি প্রধানতম নদী পদ্মা এবং মেঘনার সঙ্গমস্থলের কাছে অবস্থিত। প্রতি বছর দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে বন্যার পানি চাঁদপুরের পাশ দিয়ে পদ্মা ও মেঘনা নদীর মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে অপসারিত হয়। আর এর ফলে এই চরসহ আশেপাশে সৃষ্টি হয় তীব্র ভাঙ্গন।
রাজরাজেশ্বর চরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন্যা ছাড়াও, অবৈধভাবে নদী থেকে যত্রতত্র বালু উত্তোলন তাদের চরে ভাঙ্গনের অন্যতম কারন। আর নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে চরে বসবাসকারী মানুষের পাশাপাশি নদীর মৎসসম্পদ ও অন্যান্য জলজ পরিবেশও থাকছে নিত্য হুমকিতে।
বাংলাদেশের বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ অনুযায়ী, শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত স্থানে বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয় এবং কেবল সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু চরের স্থানীয় হতদরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া বাসিন্দারা নদীতে সবসময় চলা নির্বিচার বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে খুব একটা প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ এই ধরনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় তাদের বলতে গেলে একেবারেই কোনো ধরেনর অংশগ্রহন থাকে না। বালুমহাল বা বালু উত্তোলনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহনে সমাজের সুবিধাভাগী শ্রেনীরাই নীতিনির্ধারনী পর্যায়ের সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহনকে প্রভাবিত করতে পারে। আর এর ফলে নদী ভাঙ্গন বা জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার চেয়ে মুনাফার বিষয়গুলােই প্রধান্য পেয়ে থাকে।
সালাম (তিনি কেবল একটি নামই ব্যবহার করেন) একজন প্রান্তিক জেলে। রাজরাজেশ্বর চরের এই বাসিন্দা দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বালু খনির সাথে যুক্ত শ্রমিকরা মেঘনা এবং পদ্মা উভয় নদী থেকেই বালু উত্তোলন করে। আর এর ফলে আমাদের চরটি দুই দিক থেকে ক্রমাগত ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। রাজরাজেশ্বর চরের একপাশ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পদ্মা আর অন্যপাশে মেঘনা নদী।
নদী বৈঠক – নদী পাড়ের মানুষের কথা বলার এক নতুন প্ল্যাটফর্ম
এ অঞ্চলে নির্বিচারে বালু উত্তোলন এবং এর ফলে পরিবেশের উপর সম্ভাব্য প্রভাবের বিষয়টি অত্যন্তত জোরালোভাবে উঠে আসে যখন রাজরাজেশ্বরের বাসিন্দারা একটি নদী বৈঠকে অংশ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়।এই বৈঠকের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দেশের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় সংলাপে স্থানীয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সুশীল সমাজের সংগঠন, বিজ্ঞানী ও কর্মীদের সাথে কথা বলার সুযোগ পায় যা পুেরা প্রক্রিয়াটিকে একটি জাতীয় পরামর্শের দিকে পরিচালিত করে। এই সংলাপ থেকে উঠে আসা সুপারিশগুলো পরবর্তীতে দেশের জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন (এরআরসিসি) এবং বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর কাছে উপস্থাপন করা হয়।
নদী বৈঠক মূলত একটি সংলাপ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সুশীল সমাজ এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির তৃণমূল স্তরে নদী ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য প্রতিকারগুলো সম্মিলিতভাবে চিহ্নিত করার একটি প্রচেষ্টা। ২০১৮ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে অক্সফ্যাম-এর নেতৃত্বে ট্রান্সবাউন্ডারি রিভার অব সাউথ এশিয়া (ট্রোসা) কর্মসুচির অংশ হিসেবে শুরু হয়। পরবর্তীতে ট্রোসা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করার এই ধারণাটি আন্তর্জাতিক সংস্থা কাটস ইন্টারন্যাশনাল (কনজিউমার ইউনিটি অ্যান্ড ট্রাস্ট সোসাইটি), ভারতেও অনুশীলন করা হয়।
মূলত নদী ব্যবস্থাপনা ও নদীর পানিসম্পদের উপরে অধিকার সুরক্ষায় নীতিনির্ধারনী পর্যায়কে প্রভাবিত করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে তাদের সক্ষমতা তৈরি করাই এই কর্মসুচিটি পরিচালিত হয়।
বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে উল্লখযোগ্য বেশকিছু সাফল্য এসেছে যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে নদী পাড়ের মানুষদের নেতৃত্বে নদী ভাঙন রোধে দেশীয় পহ্নায় অবকাঠামো স্থাপন (বান্ডাল)। এটি পররর্তীতে সুশীল সমাজের সাথে সংলাপের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও (ভারত ও বাংলাদেশ) নিয়ে যাওয়া হয়।
অক্সফ্যামের এই কর্মসুচিটি লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং মায়ানমারে আন্ত:সীমান্ত নদী সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলি চিহ্নিত করে একটি টেকসই সমাধানের পথ তৈরি করা যাতে স্থানীয় সম্প্রদায়গুলােরও অংশগ্রহন নিশ্চিত করা যায়। এটি মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা এবং সালউইন নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী সম্প্রদায়ের দারিদ্র্য হ্রাস করার জন্য একত্রে কাজ করে।
বাংলাদেশে এই কর্মসুচির আ ওতায় ২০১৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৩৫টি ভিন্ন স্থানে ২০০টিরও বেশি নদী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতেও একই নদী বৈঠক
ভারতে, কাটস ইন্টারন্যাশনাল ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের (আসাম এবং ত্রিপুরা) আন্তঃসীমান্ত নদী অববাহিকা যেমন বরাক, রাইডাক (দুধকুমার), জলঢাকা (ধরলা), গোমতী, মনু, ফেনী, মুহুরি এবং খোয়াই নদীর ধারে ২০টি নদি বৌঠক সম্পন্ন করেছে।
এই বৈঠকগুলোতে তৃণমূল পর্যায়ের জনগন তাদের আর্থ-সামাজিক ও জীবিকার চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরে। নদী শাসন, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং আন্তঃসীমান্ত সম্পৃক্ততা সংক্রান্ত নীতির সফল বাস্তবায়নে আসলে এই ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ও ভারতের ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা অববাহিকায় বসবাসকারী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতি মাসে গ্রাম-পর্যায়ের এই ধরেনর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
প্রতিটি বৈঠকই এই কর্মসুচির বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সংগঠিত করে যারা প্রাসঙ্গিক নাগরিক সমাজ সংস্থাগুলির সাথে অংশীদারিত্ব তৈরি করতে এই নদী বৈঠক থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে এসে অধিকতর সংলাপ চালিয়ে যায়।

একইসাথে তারা চিহ্নিত খতিয়ে দেখতে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে এবং এই বিষয়গুলোর সাথে সম্পৃক্ত অন্যান্য সকল স্টেকহোল্ডার বা অংশীদারদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি বিশ্লেষণ পরিচালনা করে।
আলোচনা, সংলাপ, মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের পর একই ভৌগলিক অবস্থান জুড়ে আন্ত:দেশীয় নদী অববাহিকায় উভয় দেশের জনগন এবং প্রতিবেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে বেছে নেয়া হয় যাতে পরবর্তীতে সেগুলো নীতিনির্ধারণী পর্যােয় তুলে নিয়ে আসা যায়।
সবশেষে সংযুক্ত সুশীল সমাজ সংস্থাগুলো স্থানীয় জনগোষ্ঠির অংশীদারিত্বে একটি প্রাথমিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে যা পরে রাষ্ট্রীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
ভারত ও বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলি বেশিরভাগই বহুবর্ষজীবী প্রকৃতির।
বন্যা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ যেমন দূষণ, বালু উত্তোলন, পাথর উত্তোলনে নদীর তীর ক্রমাগত সরে যাচ্ছে এবং ফলস্বরূপ নদীর তীরে বসবাসকারী পরিবারগুলো তাদের বাড়িঘর এবং চাষের জমি হারাচ্ছে।
সমস্যা সমাধানে কেন স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
দক্ষিণ এশিয়ার নদীগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, তবে সকলের জন্য উন্মুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। একটি অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনা মডেলের লক্ষ্যে পানি নীতির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও এই নদী অববাহিকার উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বছরের পর বছর ধরে নদী বিষয়ক ব্যবস্থাপনায় সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সবসময়ই বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এতে নদী-নির্ভর জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিপদাপন্নতা ও দারিদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে আশংকাজনভাবে। এমনকি যখন এই সম্প্রদায়গুলো প্লাবনভূমি এবং নদীর তীর দখলের অভিযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরে, বন্যা এবং নদী ভাঙ্গন রোধে সুরক্ষা অবকাঠামোর দাবি করে, বা সেচ ও পানির জন্য পানির ঘাটতির বিষয়গুলো নিয়ে সোচ্চার হয়, ঠিক তখনই তাদের কন্ঠ তৃনমূলেই হারিয়ে যায়, নানা কারনে।
এর কারন নদী ব্যবস্থাপনাকে সবসময়ই একটি ব্যাপক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করে এর সাথে জড়িত নীতিনির্ধারকরা। তারা বিষয়টিকে এমন একটি জটিল আকার প্রদান করে যাতে মনে করা হয় এই ধরনের সমস্যার সমাধান তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু হওয়াটা সমীচিন নয়। আর এই ধারণার জন্য সবশেষে সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হয় এই নদী পাড়ের জনগোষ্ঠীকে।
এই ধরনের বৈঠকে অংশ নেয়ার মধ্য নদী পাড়ের প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীরা তাদের অধিকার ও ন্যায্যতার কথা দায়িত্বশীল পর্যায়ে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।এনামুল মজিদ খান, বাংলাদেশে অক্সফ্যামের কান্ট্রি ডিরেক্টর
আর এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই ট্রোসা কর্মসুচিটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে যাতে স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে সুশীল সমাজ এবং নীতি প্রনয়নকারীর মধ্যে এটি একটি অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। এই কর্মসুচি মূলত এই প্রক্রিয়ায় নদী ব্যবস্থাপনায় একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত সমাধান অর্জনের লক্ষ্যে অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করেছে।
নদী বৈঠক এক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে: তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পক্ষে কাজ করে যারাই আসলে নদী অর্থনীতিতে সত্যিকারের অংশীদার। নদী বৈঠকের মধ্য দিয়ে এদের উদ্বেগগুলোই চিহ্নত করা হয়।
এ ধরনের সংলাপ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নদী পাড়ের জনগণ নদী থেকে নির্বিচারে বালু ও পাথর উত্তোলন বন্ধে সরকারের কঠোর বিধিনিষেধ আরোপের দাবী জানিয়েছে।
বাংলাদেশে অক্সফ্যামের কান্ট্রি ডিরেক্টর এনামুল মজিদ খান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, “নদী বৈঠক আয়োজনের মধ্য দিেয় আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল গঙ্গা, ব্রক্ষ্মপুত্র ও মেঘনা নদী অববাহিকায় বসবাস করা সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সঠিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং এ সংক্রান্ত দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে একটি টেকসই ও সবার জন্য গ্রহনেযাগ্য সমাধানের পথগুলো বের করে নিয়ে আসতে স্থানীয় জনগনের একটি কথা বলার পরিবেশ সৃষ্টি করা। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রান্তিক জনগণ যাতে তাদের অধিকারগুলো নিয়ে সোচ্চার হতে সক্ষম হয়। আমরা দেখেছি যে এই ধরনের বৈঠকে অংশ নেয়ার মধ্য নদী পাড়ের প্রান্তিক এসব জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারীরা তাদের অধিকার ও ন্যায্যতার কথা দায়িত্বশীল পর্যায়ে পৌছে দেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এই অভিজ্ঞতাকে পুঁজি যদি এধরনের কার্যকম যেমন নদী বৈঠককে বাংলাদেশ ও ভারতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এগিয়ে নেয়া গেলে গঙ্গা – ব্রক্ষ্মপুত্র – মেঘনা অববাহিকায় যৌথ নদী ব্যবস্থাপনাকে আরো জনবান্ধব ও কার্যকর করা সম্ভব হবে।”
অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী