icon/64x64/energy শক্তি

জলশক্তি চালিত জেনারেটরের মাধ্যমে নাগাল্যান্ডে বিদ্যুতায়তন

জলশক্তি চালিত জেনারেটর বা হাইড্রোজারের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুত পৌছে দেয়ার প্রকল্পটির মধ্য দিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকা উন্নয়নের পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাড়ছে অধিকতর সহনশীলতা
বাংলা
<p>নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে বিদ্যুতায়িত করতে সাহায্য করছে হাইড্রোজার। (ছবি: নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট) </p>

নাগাল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোকে বিদ্যুতায়িত করতে সাহায্য করছে হাইড্রোজার। (ছবি: নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট)

লংগসো খুপং নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমায় শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়ন করেছন। গত বছর কোভিড-১৯ এর বিস্তার রোধ করতে কোহিমায় যখন সর্বাত্বক লকডাউন চলছে, তখন তাকে নিজ গ্রামে ফিরে আসতে হয়। কারন লক ডাউনে  শহরে সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়।  লংগসো খুপংয়ের বাড়ি নাগাল্যান্ড রাজ্যের প্রত্যন্ত এক গ্রাম কিনজুং-এ। গ্রামটি রাজ্যের তুয়েনসাং জেলায়, যার অবস্থান একেবারেই ভারত-মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি।

মাত্র কয়েক বছর আগেও বিদ্যুতের অভাবে দূরশিক্ষণের কথা ভাবাই যেত না, এটি তখন ছিল একেবারে অসম্ভব একটি বিষয়। তবে সময় পাল্টে গেছে! ছোট ছোট জলশক্তি চালিত জেনারেটর স্থাপনের মধ্য দিয়ে সেই প্রত্যন্ত গ্রামটি এখন বিদ্যুতায়িত। এতে খুব খুশি খুপং! লক ডাউন থাকলেও গ্রামে বসে বিদ্যুতের কল্যানে খুপং নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন অনায়াসেই।

ঐতিহাসিকভাবেই ভারতের উত্তর-পূর্বের পার্বত্য রাজ্য নাগাল্যান্ডের বেশিরভাগ অংশ জাতীয় বিদ্যুত গ্রিডের সাথে যুক্ত হয়নি। ভারত সরকারের গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন প্রকল্প দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রাম জ্যোতি যোজনার ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ সালে নাগাল্যান্ডের ২৭৬,৭২৬টি গ্রামীণ পরিবারের মাত্র ৫৫ শতাংশ বাড়িকে বিদ্যুতের আওতায় আনা হয়। অবশ্য এখন শতভাগই বিদ্যুতায়িত, অন্তত সরকারী তথ্য সেটাই বলছে। তবে তার মানে এই নয় যে প্রতিটি বাড়িই শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে, কিংবা কেবল গৃহস্থালি পর্যায়ে বিদ্যুতায়তন সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি এই তথ্য থেকে এটাও পরিস্কার নয় যে প্রতিটি পরিবার কী পরিমান বিদ্যুত ব্যবহার করে থাকে।  

কিনজুংয়ের মতো গ্রামগুলোতে শিশুরা স্কুলের পরে পরিবারের সদস্যদের কৃষি জমিতে কাজ করতে সাহায্য করে। সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফিরে তারা পাইন গাছের ফলে আগুন জ্বালিয়ে স্বল্প আলোতে পড়ালেখার চেষ্টা করে। এম মংতসোয়া কিনজুং গ্রামের গির্জার একজন যাজক। তার দেয়া তথ্য মতে, ২০১০ একটি জল বিদ্যুত উৎপাদনকারী জেনারেটর (হাইড্রোজার) প্রথমবারের মতো স্থাপন করা হয়। নাগাল্যান্ডে বিদ্যুতায়ন মানে সেখানকার জন্য একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন – বিশেষ করে গ্রামীন এই অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সক্ষমতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি সেখানকার স্থানীয় অর্থনীতির জন্য এটি একটি বিরাট সুযোগ। 

গ্রামীণ বিদ্যুয়াতনে নাগাল্যান্ড সরকারের প্রচেষ্টা

২০০৭ সালে নাগাল্যান্ড সরকার গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়ন তদারকির জন্য নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু  এনার্জি ডেভেলপমেন্ট (এনইপিইডি) প্রক্রিয়া চালু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ জনগণের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি করা।

দ্য থার্ড পোলের সাথে আলাপকালে এনইপিইডি-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের একজন তাকুম চ্যাং বলেন, ২০০০ সালের গোড়ার দিকে আমরা যখন কাজ শুরু করি তখন নাগাল্যান্ডের বেশিরভাগ গ্রামের সঙ্গেই জাতীয় বিদ্যুত গ্রিডের কোনো সংযোগ ছিল না।

যেহেতু নাগাল্যান্ডে বহু জলধারা এবং পাহাড়ি স্রোতধারা রয়েছে, তাই এইসব ধারাকে ব্যবহার করে বিদ্যুত উৎপাদন করা যায় কিনা তা নিয়ে শুরু থেকেই কাজ করছিল এনইপিইডি।

প্রাথমিক অবস্থায় ২০০৭ সালে তারা চীন থেকে আমদানি করা পিকোজেনারেটর নামে এক ধরনের যন্ত্র স্থাপন করে। এই ধরনের ছোট ছোট জেনারেটরগুলো মূলত মধ্যাকর্ষণ শক্তি ব্যবহার করে থাকে: পাহাড় থেকে নিচের দিকে ধাবিত জলধারার শক্তি ব্যবহার করে টার্বাইন ঘোরানোর ক্ষেত্রে এগুলো ব্যবহৃত হয়। প্রাক শিল্প বিপ্লবের সময় এই পদ্ধতি ব্যবহারের মধ্য দিয়েই জলকলগুলো পরিচালনা করা হতো।

যাই হোক, এই পিকোজেনারেটরগুলো ঘন ঘন রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, এগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশ সংগ্রহে বেশ অসুবিধা পোহাতে হয়, পাশাপাশি এসব যন্ত্রাংশের আমদানি ব্যয় বেশি। এজন্য এই ধরনের যন্ত্র ক্রমেই ব্যবহারের ক্ষেত্রে অযোগ্য হিসেবে পরিগণিত হয়।

এনইপিইডির নিজস্ব জলচালিত জেনারেটর উদ্ভাবন

এসব কারনে এনইপিইডই নিজেই জেনারেটর উদ্ভাবনে আগ্রহী হয়। আর এর নামই হচ্ছে হাইড্রোজার : হাইড্রোলিক পাওয়ার (বাংলায় জলশক্তি) ও জেনারেটরের সংক্ষিপ্ত রুপ হাইড্রোজার। ইয়াঙ্গার ইমচেন বলেন, নিয়মিতভাবে নকশা প্রণয়ন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধারাবাহিকতায় এটি তৈরি করতে আমাদের এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়।

পেরেন জেলার পোইলওয়া গ্রামে নিজের খামারে একটি হাইড্রোজার স্থাপন করেন দাতুই জেলিয়াং। তিনি বলেন, তিন বছর ধরে আমি চীনের তৈরি একটা জেনারেটর ব্যবহার করেছি। সেটি তেমন ভালো ছিলনা। কিন্তু নতুন হাইড্রোজারটি বেশ ভালো।

এনইপিইডি এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫০টি নতুন মেশিন তৈরি করেছে, যার দুই-তৃতীয়াংশ নাগাল্যান্ডে এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রতিবেশী কয়েকটি রাজ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা ডিমাপুর শহরে অবস্থিত নাগাল্যান্ড টুল রুম এবং ট্রেনিং সেন্টার-এর সাথে যৌথভাবে এই যন্ত্রটি প্রস্তুত করছে। এই সংস্থাটি সরকারী কর্মচারি ও বেসরকারী ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে গঠিত একটি রেজিষ্টিকৃত সংগঠন। স্থানীয়ভাবে এটি উৎপাদন করার ফলে আমদানি ব্যয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি জেনারেটরগুলির মেরামতের ক্ষেত্রেও জটিলতা কমে এসেছে।

Sites with good gravity flow are identified for installing hydrogers (Image: Yanger Imchen / Nagaland Empowerment of People through Energy Development)
হাইড্রোজার স্থাপনের ক্ষেত্রে মাধ্যাকর্ষণ প্রবাহ রয়েছে এমন স্থান নির্বাচন করা হয় (ছবি: নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট)

এনইপিইডির প্রকল্প সমন্বয়ক ইমনায়াঙ্গার ইমচেন বলেন, আমাদের সংস্থা প্রথমে একটি সম্ভাব্য এলাকা চিহ্নিত করে যেখানে প্রাকৃতিক কারনে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে জল পুরোপুরিভাবে উপর থেকে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এরপর মেশিনটি ডিমাপুর থেকে পরিবহন করে সেখনে নিয়ে যাওয়া হয়। মেশিনটি এরপর নির্দিষ্ট সেই গ্রাম ও নদীর মধ্যবর্তী স্থানে স্থাপন করা হয়। নদী থেকে অপসারণ করে জেনারেটরে জল পৌছে দেয়ার জন্য পাইপ এবং সরু খাল তৈরি করা হয়। জেনারেটরের মধ্য দিয়ে জলের ব্যবহারের পর তা নিষ্কাশন করে আবার নদীতে ফিরিয়ে দেয়া হয় – অথবা অপসারিত জল কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়।

A hydroger being tested. On the right is an electronic load controller, which is made by NEPeD to maintain the balance between supply and demand of the electricity. (Image: Yanger Imchen / Nagaland Empowerment of People through Energy Development)
একটি হাইড্রোজার (বায়ে) পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এই যন্ত্রের মাধ্যমে জলের ব্যবহার সম্পন্ন হলে তা পাহাড়ের নিচে প্রবাহিত হয়ে নদীর সাথে গিয়ে মিশে যায়। এনইপিইডি-র তৈরি করা একট বৈদ্যুতিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র (ডানে) বিদ্যুতের চাহিদা ও সরাবরাহের সমন্বয় করে থাকে। (ছবি:  নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট)

প্রতিটি বাড়িতেই দুই – তিনটি করে এলইডি বাতি রয়েছে এবং একই সঙ্গে রয়েছে সমান সংখ্যক চার্জিং পয়েন্ট। এই পয়েন্টগুলোর মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ফোন এবং অন্যান্য ডিভাইস চার্জ করে নিতে পারেন। কিছু গ্রামে আবার হাইড্রোজার চালিত সড়ক বাতিও রয়েছে।

গ্রামে বসবাসরত জনগণ উৎপাদিত বিদ্যুত কী পরিমানে ব্যবহার করতে পারবে সে ব্যাপারে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করে স্থানীয় গ্রাম কমিটি, যাতে নারীরাও সদস্য হিসেবে রয়েছে। 

স্থানীয় প্রকৌশলীরা যারা এনইপিইডি দ্বারা প্রশিক্ষন পেয়েছে তারাই এই মেশিনগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং ছোটখাটো মেরামত করে থাকে  – এর মাধ্যমে নতুন নতুন কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা ও জীবনমান উন্নয়নে যে সুবিধাগুলো পাওয়া যাচ্ছে

কৃষিভিত্তিক সম্প্রদায় হিসেবে কিনজুংয়ের বাসিন্দারা সাধারণত বাড়ি থেকে একটু দুরে কৃষি জমিতে কাজ করতে গিয়ে থাকে। আগে কৃষি জমিতে কাজ শেষ করে সন্ধ্যার আগেই তাদের বাড়িতে ফিরতে হতো গৃহস্থালি কাজগুলো শেষ করার জন্য। এখন বৈদ্যুতিক বাতি আসার ফলে তারা নিজেদের জমিতে আরো বেশি সময় কাজ করতে পারে, যাতে উৎপাদনশীলতাও বাড়ছে। 

মোকোকচুং জেলার লংকুং গ্রামে তোশি লংকুনার তার খামারের আলো জ্বালাতে এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য হাইড্রোজার উৎপাদিত বিদ্যুত ব্যবহার করে। দ্য থার্ড পোলকে তিনি বলেন, বিদ্যুত সংযোগ পাওয়ার ফলে আমি এখন আরো বেশি কাজ করতে পারছি এবং পাশাপাশি আরো বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে আমার খামারে।

পেরেন জেলার আরেক চাষী দাতুই জেলিয়াং। তার  রয়েছে কমলা, কলা এবং ওক গাছ ও মাছের খামার। তিনি ফলের গাছ থেকে কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করার জন্য আলোর ফাঁদ ব্যবহার করেন যাতে এসব কীটপতঙ্গ ফসলকে বিনষ্ট করতে না পারে। পাশাপাশি উৎপাদিত ফসল বাছাই করার জন্য তিনি সন্ধ্যার পরেও কাজ করতে পারেন। একই সঙ্গে তিনি  হাইড্রোজারের জল ব্যবহার করে তার ফসলের কৃষি জমিতে সেচ প্রদানসহ মাছে খামারে জল সরাবরাহ করে থাকেন।

Installation and maintenance are done by local villagers, helping them earn (Image: Yanger Imchen / Nagaland Empowerment of People through Energy Development)
হাইড্রোজার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ স্থানীয় গ্রামবাসিরাই করে থাকে, এটি তাদের জন্য একটি অতিরিক্ত আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। (ছবি:  নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট)

বাড়ি ফিরে গ্রামবাসীরা এখন রাতে অতিরিক্ত কাজ করতে পারে যা তাদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

এনইপিইডি – এর তাকুম চ্যাং বলেন, গ্রামবাসীরা এখন রাতে ঘরেই তাদের উৎপাদিত শাকসবজি বাছাই করতে পারে। অনেকেই এখন আবার ঝুড়ি  বোনার কাজ শুরু করেছে বলে জানান তিনি।

এম মংতসোয়া বলেন, গ্রামবাসীরা এখন রাতের বেলা উলের বুননের কাজ করছে। আর বিদ্যুত সংযোগ থাকা মানে হচ্ছে কাঠের মিস্ত্রীরা নানা ধরনের স্বয়ংক্রিয় সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারে যার মাধ্যমে তারা এখন আরো দ্রুত ও দক্ষতার সাথে কাজ করতে পারে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কী এই প্রকল্পকে প্রভাবিত করবে?

নাগাল্যান্ডের জলধারা ও প্রপাতগুলো দীর্ঘস্থায়ি এবং বছর জুড়েই বিদ্যুত উৎপাদনের ক্ষেত্রে এগুলো সহায়তা করে থাকে। কিন্তু এ ধরনের জলধারা ও জলের উৎসগুলো রাজ্য জুড়েই শুকিয়ে যাচ্ছে – এ বছরের শুষ্ক মৌসুম এটিকে বেশ প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। তোশি লংকুনার বলেন, শীত মৌসুমে তার খামারে বিদ্যুত উৎপাদন কমে আসে, কারণ সেসময় খুব একটা বৃষ্টি হয়না। 

এছাড়া খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিরুপ আবহাওয়ার জন্য নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় বন্যা বেড়েছে। ইমচেন বলেন, আমরা জেনারেটরগুলো স্থাপন করার সময়  এসব বিষয়ে স্থানীয় ধারণার বিষয়গুলো মাথায় রাখি এবং জলধারাগুলো থেকে কিছু কিছু নালার মতো তৈরি করে জলের প্রবাহকে অপসারণ করি। আকষ্মিক বন্যার ক্ষেত্রে আমাদের এই জেনারেটরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, মোটামুটি নিরাপদ থাকে। আবার নালাগুলোর ছোটোখাটো ক্ষয়ক্ষতি হলে আমরা তা অনায়াসেই মেরামত করতে পারি।

জলচালিত জেনারেটর সৃষ্ট পরিবেশগত প্রভাব

ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স-এর সহকারী অধ্যাপক পুনিত সিং বলেন, তুলনামূলকভাবে বড় আকারের জলবিদ্যুত প্রকল্পের চেয়ে হাইড্রোজারের উপকারীতা বেশি। কারণ ড্যাম বা বাঁধের তুলনায় এই ধরনের প্রকল্পের মাধ্যমে পরিবেশের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। তিনি দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বিকেন্দ্রীকরণের চ্যালেঞ্জ এবং হাইড্রোজারের সংখ্যা বেশি হওয়া ছাড়াও, স্থানীয় প্রতিবেশ ও জল সংক্রান্ত চক্রের বিষয়গুলো আমাদের পর্যালোচনা করা উচিত।

গবেষণা ও আ্যডভোকেসি নিয়ে কাজ করা বেসরকারী সংস্থা সাউথ এশিয়া নেটওয়ার্ক অন ড্যামস, রিভার্স অ্যান্ড পিপল– এর সমন্বয়ক হিমাংশু থাক্কার বলেন, হাইড্রোজারের প্রভাব খুব সামান্য এলাকার ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে। জলজ জীববৈচিত্র্যের উপরে এর প্রভাবের বিষয়ে তিনি বলেন, পাহাড়ি এলাকায় ছোট ছোট জলের ধারাগুলোতে বিশেষ জীববৈচিত্র্যের আধিক্য না-ও থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মনে করেন।

The hydrogers are easily transported to sites in the hilly state (Image: Yanger Imchen / Nagaland Empowerment of People through Energy Development)
পার্বত্য রাজ্যে খুব সহজেই হাইড্রোজার বহন করে যে কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া যায় (ছবি:  নাগাল্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট অব পিপল থ্রু এনার্জি ডেভেলপমেন্ট))

তবে পাহাড়ি জলধারা ও ঝিরি থেকে জল অপসারনের ক্ষেত্রে ভূমিতে নানা ধরনের কাজ করতে হয়। এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, এ ধরনের কাজ করতে হলে একদম সঠিকভাবে করা উচিত। তিনি বলেন, জল অপসারনের কারনে ভাটির দিকে বসবাস করা মানুষেরা ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে। তাছাড়া এর ফলে জলাধারগুলো পুনরায় পরিপূর্ণ হওয়া এবং জলচক্রের উপরে নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে।

পুনিত সিংয়ের মতে, এই ধরনের প্রকল্পের ফলে পরিবেশের উপরে অণুবীক্ষণিক প্রভাব পড়বে। তবে ভঙ্গুর পরিবেশ সুরক্ষায় জনবান্ধব ও ক্ষমতায়নের মতো প্রযুক্তির যথেষ্ট সহায়তা করে থাকে।

জীবাশ্ম জ্বালানি চালিত জেনারেটরের মতো হাইড্রোজার প্রকৃতিতে দূষণ সৃষ্টি না করলেও, যে কোনো যন্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে পরিবেশে এক ধরনের প্রভাব পড়েই থাকে। রাতের বেলা আলো জ্বালাতে গ্রামবাসীদের আর কাঠ পোড়ানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায় বনভূমি। যাজক মংতসোয়া বলেন, গ্রামবাসীরা এখন সবুজায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট। পাশাপাশি তারা পাহাড়ি জলধারা ঠিক রাখতে নিষ্কাশন ব্যবস্থাগুলোও সুরক্ষায় কাজ করে। এটি জলধারার প্রবাহ অব্যাহত রাখাসহ পরিবেশের সহনশীলতা আরো বৃদ্ধি পায়।

এনইপিইডি কর্মশালার আয়োজন করার পাশাপাশি প্রকৃতি সংরক্ষণের বিষযে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জনগনকে সবুজ বৃক্ষ, বৃষ্টিপাত ও জলচক্রের মধ্যকার সম্পর্কে স্থানীয়দের সম্যক ধারনা প্রদান করে থাকে।

হাইড্রোজার এখন নাগাল্যান্ড ছাড়িয়ে

শুধু নাগাল্যান্ড নয়, এনইপিইডি এখন পাশের রাজ্য সিকিম, মেঘালয়, মণিপুর এবং অরুণাচলে আরো ৪৯টি হাইড্রোজার স্থাপন করেছে।

প্রতিবেশী রাজ্য মেঘালয়ে বসবাসকারী দনবোক বুয়াম প্যারাডাইস অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর এবং ক্রাং শুরি অ্যাডভেঞ্চার ট্যুর  নামে দুটি সংস্থা পরিচালনা করেন। সংস্থা দুটি পর্যটকদের থাকার স্থান ও খাবার প্রদান করে থাকে – এসব স্থাপনা পরিচালনায় প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের যোগান আসে হাইড্রোজার থেকে।

বিদ্যুত সরাবরাহের সুবিধা থাকায় বুয়াম এখন পর্যটকদের জন্য আগের চেয়ে আরো বেশি কর্মকান্ড পরিচালনা করতে পারে যা মুনাফা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পাশাপাশি গ্রামের অনেকের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ।

এখন পর্যন্ত কর বাদে প্রতিটি হাইড্রোজারের জন্য ব্যয় হয় ১৬০,০০০ ভারতীয় রুপি বা প্রায় ২,১৭০ মার্কিন ডলার। নাগাল্যান্ডের অনেক পশ্চাতপদ এলাকার মতো অন্যান্য পশ্চাতপদ এলাকায় এনইপিইড বিনামূল্যে জেনারেটর প্রদান করে থাকে। তবে বুয়ামের ব্যক্তিগত পর্যটন সংস্থার মতো অন্যান্য বেসরকারী কোম্পানি  বা সংস্থাকে এই ধরনের যন্ত্রের জন্য অবশ্য অর্থ ব্যয় করতে হয়। 

আনুষ্ঠানিকভাবে নাগাল্যান্ড এখন শতভাগ বিদ্যুতায়িত একটি রাজ্য হলেও এই প্রকল্পটি অব্যাহত থাকবে বলে দ্য থার্ড পোলকে জানান ইমচেন। এখনও হাইড্রোজারের জন্য অনুরোধ আসছে তাদের কাছে কারন গ্রামীন জনগন স্বাভাবিকভাবেই তাদের বিদ্যুত ব্যবহারের সক্ষমতা আরো উত্তরোত্তর বাড়াতে আগহী। 

অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী