icon/64x64/climate জলবায়ু

উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার পেছনে অন্যতম কারণ স্থবির বর্ষা

পূর্ব দিক থেকে পর্যাপ্ত বাতাসের অভাব আর আবহাওয়ার বৈরি ধরণের মানে উত্তর ও মধ্য ভারতে স্বল্প বৃষ্টিপাত
<p>বাংলাদেশের সিলেট জেলায় চলতি বছরের জুন মাসে অস্বাভাবিক বন্যায় বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় নৌকায় চড়ে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ছে একটি পরিবার। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাতাসের অস্বাভাবিক ধরণে এই বছরের বন্যা পরিস্থিতি মারাত্বক আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা (ছবি: সিনহুয়া / এলামি)</p>

বাংলাদেশের সিলেট জেলায় চলতি বছরের জুন মাসে অস্বাভাবিক বন্যায় বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় নৌকায় চড়ে আশ্রয়ের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ছে একটি পরিবার। জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে বাতাসের অস্বাভাবিক ধরণে এই বছরের বন্যা পরিস্থিতি মারাত্বক আকার ধারণ করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা (ছবি: সিনহুয়া / এলামি)

২০২২সালে বছরের প্রথমার্ধে তীব্র তাপদাহ এবং ভারী বন্যায় মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয়ের সর্বশেষ শিকার উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশ, যেখানে ব্যাপক বন্যায় কয়েক হাজার বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হওয়ার পাশাপাশি হারিয়েছে তাদের জীবন-জীবিকা।

১১ থেকে ১৯ জুনের মধ্যে, এই অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে, যার ফলে ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক নদী বন্যার পানিতে উপচে পড়ে। এবারের বন্যার ফলে কয়েকশত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং প্রায় ৫.৫ মিলিয়ন মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুনের শেষে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামের ৩৫টি জেলার মধ্যে ২৮টি এখনও বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া আসামের শিলচর আর বাংলাদেশের সিলেটের মতো বড় শহরগুলো এখন পর্যন্ত নিমজ্জিত, অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব ভারতের আরেক রাজ্য মণিপুরে অবিরাম বৃষ্টির কারণে গত ২৯ জুন ভূমিধসে কমপক্ষে ৪২ জনের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেছে।

অস্বাভাবিক বায়ু প্রবাহের কারনে অতিবৃষ্টি

আসামের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যা এবং এর ভাটিতে বাংলাদেশে প্রতি বছর বন্যা দেখা যায়। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার বার্ষিক মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় অধিকাংশই জুন-সেপ্টেম্বরের বর্ষা মৌসুমটিতে ঘটে থাকে।

কিন্তু চলতি বছর, পূর্ব দিক থেকে আসা বায়ু প্রবাহের অনুপস্থিতির কারণে পরিস্থিতি আরও তীব্র আকার ধারণ করে কারণ এই বায়ু প্রবাহ সাধারণত মৌসুমি মেঘকে ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমিতে ঠেলে দেয় বলে মনে করেন ইন্ডিয়া মেটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (আইএমডি) একজন সিনিয়র বিজ্ঞানী আর কে জেনামানি। আর কে জেনামিন দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলার সময় বলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের কাছে যেহেতু পানিভর্তি ভারী মেঘগুলো আটকে যায়, তাই এই অঞ্চলে ভারী বর্ষনের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারেও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

তিনি বলেন, “বছরের এই সময় পূব দিক থেকে যে বায়ু প্রবাহ চলাচলের কথা ছিল তা এখন সেভাবে হচ্ছে না। “পরিবর্তে, আমরা বঙ্গোপসাগরের উপর শক্তিশালী দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমী বায়ু প্রবাহ দেখতে পাচ্ছি, যা উড়িষ্যা [উত্তর পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ] থেকে তাদের সাথে আরও আর্দ্রতা নিয়ে এসেছে। এছাড়াও, উড়িষ্যায় ‘বায়ু প্রবাহ ব্যবস্থার গঠন’, যা সাধারণত উত্তর-পূর্ব ভারতে চলে যাওয়া বায়ু প্রবাহের প্রভাবকে কমিয়ে দেয়, এই বছর তা ঘটেনি।”

South Asia wind patterns
পূর্ব দিক থেকে আসা বায়ু প্রবাহের অনুপস্থিতির ফলে এই বছর বাংলাদেশ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপক বন্যা দেখা দিয়েছে । গ্রাফিক -দ্য থার্ড পোল।

সাধারণত গ্রীষ্মকালে, উড়িষ্যার উপর একটি নিম্নচাপ তৈরি হয় এবং ভারত মহাসাগর থেকে উচ্চ চাপের বায়ু প্রবাহ এই এলাকার দিকে চলে যায় এবং বয়ে নিয়ে আসে বৃষ্টিপাত।

তিনি আরও একটি বিরল ঘটনার দিকেও ইঙ্গিত করেছিলেন, যা পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। এই বছর, আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর উভয় থেকে আর্দ্রতা র্পূণ বায়ু প্রবাহ জুনের মাঝামাঝি সময়ে একই সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে চলে যায় যা সাধারণত, বিভিন্ন সময়ে এই দিকে চলে আসতো।

৩,৩৪৫ মিমি

আট দিনে উত্তর-পূর্বে বৃষ্টিপাত, পুরো বর্ষা মৌসুমে মুম্বাইয়ে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় তার সমান

এই অস্বাভাবিক ঘটনার সংমিশ্রণের কারণে, আসামে খুব উচ্চ মাত্রার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যার ফলে বিপর্যয়কর বন্যা হয়েছে।

“মাত্র আট দিনে [১১- ১৯ জুন], উত্তর-পূর্বে প্রায় ৩,৩৪৫ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। চার মাসের পুরো বর্ষা মৌসুমে এটিই সর্বোচ্চ যা মুম্বাইতে ঘটে। দিল্লিতে একই সময়ে, মাত্র ৫০০ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়,” জেনামানি বলেন।

স্থবির বর্ষার মুদ্রার অপর দিক হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে বৃষ্টিপাতের ঘাটতি। আইএমডি‘র তথ্য অনুযায়ি জুন মাসে গড় বৃষ্টিপাত সমগ্র উত্তর এবং মধ্য ভারতে, উড়িষ্যায় গড়ের চেয়ে৩৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে৷ ২০২২ সালে এখনও পর্যন্ত ব্যাপক তাপপ্রবাহ এবং দাবানলের কারণে উত্তর ভারত ইতিমধ্যেই কৃষি, জীবিকা এবং বাস্তুবিদ্যার বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ফসল কাটার মৌসুমে দাঁড়িয়ে থাকা ফসলের যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষতি করার পরে ভারতকে এই বছর গম রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হয়েছিল। এতে বিশ্বব্যাপী গমের বাজারে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

বায়ু প্রবাহে বিধ্বংসী পরিবর্তন

দ্য থার্ড পোলের সাথে কথা বলার সময়, দিল্লিতে অবস্থিত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (হাইড্রোলজি) বিভাগের অশোক কুমার কেশারি নিশ্চিত করেন যে এই বছরের আবহাওয়ার ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতে পারে। “উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বায়ু প্রবাহের সঞ্চালনের ধরণ পরিবর্তন হচ্ছে। যেহেতু বন্যা হয় পরিবাহী বৃষ্টিপাতের কারণে [যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠে উত্তপ্ত বায়ু জলীয় বাষ্পের সাথে বেড়ে যায়, তারপর ঠান্ডা হয় এবং ঘনীভূত হয়], যা চাপের ধরণ তৈরি করে, আবহাওয়ার ধরণগুলি অনির্দেশ্য হয়ে উঠে,” তিনি বলেন।

কেশারি বলেন, আসলে বৃষ্টির তীব্রতা বৃদ্ধি পেলেও, বৃষ্টিপাতের সময়কাল (আর্দ্র দিনের সংখ্যা) সারা ভারতে ছোট হয়ে আসছে। অন্য কথায়, বেশিরভাগ এলাকা, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে  সামান্য সময়ে অনেক ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। এমনকি যদি এক মাস বা একটি মৌসুমে মোট বৃষ্টিপাতের একটি বড় তারতম্য না দেখালেও, শুষ্ক দিনের সময়কাল পরিবর্তিত হয়েছে ব্যাপকভাবে।

“সাধারণত, বিভিন্ন সময়ে আরব সাগর এবং বঙ্গোপসাগর থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। কিন্তু এই বছর, এটি একই সাথে ঘটেছে, তাই প্রভাব প্রসারিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত, এই ধরনের ঘটনা কেবল ভবিষ্যতে বাড়তেই থাকবে বলে মনে করেন তিনি। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন ভূমি এবং পানির তাপমাত্রাকে প্রভাবিত করে, তাই উচ্চ এবং নিম্নচাপের ধরণগুলি পালাক্রমে পরিবর্তিত হবে, যার অর্থ হচ্ছে বৃষ্টিপাত কেমন হতে পারে সে বিষয়ে অনুমান করা অনেকটাই দূরহ হয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌসুমি বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তনের আরেকটি অন্যতম কারন হচ্ছে সমুদ্রাঞ্চলে তাপদাহ (MHWs) ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং সাগর বা মহাসাগরের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রার বৃদ্ধির সময়কাল যা চাপের ধরণকে প্রভাবিত করে। রক্সি ম্যাথিউ কোল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেটিওরোলজির একজন সিনিয়র জলবায়ু বিজ্ঞানী যিনি আন্তঃসরকারি প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) এর সর্বশেষ প্রতিবেদনের প্রধান লেখক। সম্প্রতি তিনি একটি  গবেষণায় লিখেছেন, “পশ্চিম ভারত মহাসাগর অঞ্চলে প্রতি দশকে ০.৪ – ০.৫  হারে   তাপ প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রতি দশকে এই ধরনের তাপ প্রবাহের হার ১.২ থেকে ১.৫। অর্ধাৎ এই ধরনের পরিবর্তিত পরিস্থিতির ঘটার হার বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিম ভারত মহাসাগরে কিছুটা বেশি…যা আসলে এই ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যাঞ্চলে মৌসুমি ঋতুতে স্বল্প মাত্রায় বৃষ্টিপাতের জন্য দায়ী।“

এই পরিস্থিতিতে করণীয় কি?

আসাম ভারতের সবচেয়ে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ রাজ্য, দেশের ২০টি জলবায়ু-সংরক্ষিত জেলার মধ্যে কেবল এই রাজ্যেরই রয়েছে ১১টি। যদিও রাজ্য সরকার প্রয়োজনের সময় কিছু জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে যেমন সংকটকালীন সময়ে খাদ্য, ওষুধ এবং আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে রাজ্য সরকার, পাশাপাশি, সুরক্ষা বাঁধগুলিকে শক্তিশালী করার কাজ করতে পারে। তবে বন্যা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যান্য বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যে প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাজ্য সরকারগুলো দুর্যোগ মোকাবেলায়  কাজ করে থাকে তাতে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন হওয়া দরকার
আদিত্য ভ্যালিয়াথান পিল্লাই, নয়াদিল্লি ভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ

নয়াদিল্লি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পলিসি  রিসার্চের জলবায়ু, শক্তি, এবং পরিবেশ বিষয়ক উদ্যোগ সংক্রান্ত বিভাগের ফেলো আদিত্য ভ্যালিয়াথান পিল্লাই মনে করেন, একবার এই বন্যার পানি সব দিক থেকে নেমে গেলে এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ পরিচালনাকরী দলগুলো চলে গেলে, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা মারাত্বক একটি অন্ধকার অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে চরম আবহাওয়ার ঘটনাগুলি যখন একটির সাথে অন্যটি সাংঘর্ষিক অবস্থায় চলে গেলে জটিল  প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করার ক্ষেত্রে বহু-স্তরের শাসন এবং সহিঞ্চু পরিকল্পনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

পিল্লাই বলেন, “যে প্রক্রিয়ায় সাধারণত রাজ্য সরকারগুলো দুর্যোগ মোকাবেলায়  কাজ করে থাকে তাতে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তন হওয়া দরকার।” “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলোর সাথে জনগনের খাপ খাইয়ে নিতে রাজ্য সরকারগুলোর শক্তিশালী কর্ম পরিকল্পনা থাকা দরকার। আর এটি তখনই সম্ভব হবে যখন শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন কর হবে।” তিনি বলেন, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার এই ধরনের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত হবার কথা না হলেও এটি রাজ্যগুলির যাতে অনুসরণ করতে পারে এমন সব নীতি প্রনয়নের ক্ষেত্রে প্রনোদনাসহ নানা ধরনের সুবিধাদি প্রদান করতে পারে…পাশাপাশি আরকেটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যাতে করে রাজ্য সরকার এসব আইন, নীতি  ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত তহবিল বা আর্থিক সক্ষমতা পেতে পারে।“

একটি মন্তব্য যোগ করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.