জলবায়ু

ব্যাখ্যা: কার্বনের বাজার বাণিজ্য কি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায়  সহায়তা করতে পারে?

আপাত দৃষ্টিতে কার্বনের বাজার/বাণিজ্য দেখে হয়ত মনে হতে পারে যে এর প্রভাবে 'দূষণকারীরা সমুচিত জবাব পাচ্ছে' এবং জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে সরে আসার বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে - কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি বেশ জটিল
<p>কার্বনের নির্গমনের মাত্রা হ্রাস করতে বৃক্ষ রোপন একটি প্রচলিত উদাহরণ যে প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ধরেনর কর্মসূচির জন্য অর্থ প্রদান করে থাকে যার মাধ্যমে দূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে নির্গত কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে  অপসারণ করা যেতে পারে বলে মনে করা হয় (ছবি: এ্যালামি)</p>

কার্বনের নির্গমনের মাত্রা হ্রাস করতে বৃক্ষ রোপন একটি প্রচলিত উদাহরণ যে প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এই ধরেনর কর্মসূচির জন্য অর্থ প্রদান করে থাকে যার মাধ্যমে দূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে নির্গত কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে  অপসারণ করা যেতে পারে বলে মনে করা হয় (ছবি: এ্যালামি)

তাপযুক্ত কার্বন নির্গমন রোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোকে বাধ্য করতে অনেকেই কার্বনের মূল্য নির্ধারণকে একটি চূড়ান্ত সমাধান হিসেবে মনে করে থাকেন। দূষণকারী কার্যকলাপের উপর ‘কার্বন ট্যাক্স’ এর বাইরে, কেউ কেউ আবার কার্বন নির্গমন কমাতে একটি আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের মতো একটি প্রত্রিয়ার সমর্থন করছেন যাকে বলা হচ্ছে  কার্বন বাণিজ্য।

যাইহোক, অসংখ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা এটা এখন প্রমানিত যে, ‘দূষণকারীদের অর্থ প্রদানে বাধ্য’ করার মতো সরল এই নীতির বাস্তবায়ন  বেশ দূরহ একটি কাজ।

কার্বন বাণিজ্য কি এবং কিভাবে তারা কাজ করে?

কার্বন বাজার বা কার্বনের বাণিজ্য নির্গমন বাণিজ্য স্কিম হিসাবেও পরিচিত। এমন কিছু চুক্তি রয়েছে যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ বা অন্যান্য ব্যক্তি  বা বাণিজ্যিক সংস্থা কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের  অনুমতি বিনিময় করে, যা প্রায়ই কার্বন ক্রেডিট নামে পরিচিত।

কার্বন ট্রেডিং মার্কেটের মাধ্যমে, বিভিন্ন দেশ বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্বন নির্গমন মাত্রা তাদের জন্য সম্মত মাত্রার নিচে কমিয়ে অবশিষ্ট মাত্রা কার্বন ক্রেডিট আকারে অন্যদের কাছে বিক্রি করতে পারে যারা এখনও সম্মত সীমার বাইরে দূষণ করছে। তাত্ত্বিকভাবে, এটি নির্গমন কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এক ধরনের আর্থিক প্রণোদনা।

কার্বন বাজার বা বাণিজ্যকে সাধারণভাবে দেথা হয় এমন একটি প্রক্রিয়া হিসেবে যার মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে সৃষ্ট ব্যয়গুলোকে বেঁধে ফেলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অন্যান্য সমস্যার পাশাপাশি ঘন ঘন এবং তীব্র তাপপ্রবাহ, ঝড়, বন্যা, খরা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার দ্বারা চালিত হওয়া সত্ত্বেও, এই জলবায়ু বিপর্যয়ের ঠেকাতে নেয়া প্রস্তুতির সাথে জড়িত ব্যয়  – এবং এসব বিপর্যয় আঘাত করার পরে ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার জন্য যে সব ব্যয় প্রয়োজন তা সরাসরি জীবাশ্ম জ্বালানির মূল্যের সাথে হিসাব করা হয় না। বরং এই ব্যয়ভার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সাধারণত দেশের নাগরিক এবং সরকারকে বহন করতে হয়, যারা অনেক ক্ষেত্রেই বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য কোনোভাবেই অতীত বা বর্তমান দায়ী নয়। এই কার্বন মার্কেটের মাধ্যমে তাত্ত্বিকভাবে এই ব্যয়গুলোকে দূষণকারীদের উপর ন্যাস্ত করা যেতে পারে যারা দূষণ সৃষ্টিকারী কার্যকলাপগুলি চালিয়ে যেতে  আরও ক্রেডিট কিনতে অর্থ ব্যয় করতে পারে।

কার্বন ক্রেডিট এবং কার্বন অফসেট কি?

কার্বন লেনদেনের দুটি প্রধান প্রকার রয়েছে: ক্রেডিট এবং অফসেট। কার্বন ক্রেডিট মূলত ভবিষ্যৎ নির্গমনের প্রতিনিধিত্বকারী অর্থাৎ সরকার বা কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য  জারি করা হয়।  শুধুমাত্র তারাই যারা তাদের ‘ভাতা’-এর চেয়ে কম নির্গমন করে – এবং তাই অতিরিক্ত ক্রেডিট নিয়ে তা শেষ করা যায়  এবং  তখন সেগুলিকে মুক্ত বাজারে লেনদেন করতে পারে।

আর কার্বন অফসেট হচ্ছে বাণিজ্যিক কোম্পানি দ্বারা তৈরি এবং বাণিজ্য করার স্বার্থে তা চালু করা হয়।  যদি একটি প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণ করার জন্য কিছু করে, যেমন বৃক্ষ রোপন, তাহলে এটিকে কার্বন অফসেট হিসাবে গণনা করা যেতে পারে এবং বাজারে অন্যান্য সংস্থার সাথে তারা বাণিজ্য করতে পারে। আবার ব্যক্তি পর্যায়েও কার্বন নির্গমনকে ‘অফসেট’ করা যেতে পারে, যেমন উচ্চ-কার্বন ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ বিমান ভ্রমন কমিয়ে আনা যেতে পারে, কিংবা কার্বন অপসারণ প্রকল্পে দান করে, বনায়ন কর্মসূচি বা নবায়নযোগ্য শক্তি বিকাশের মতো কার্যক্রমে অংশ নেয়ার মাধ্যমে এটি করা যেতে পারে।

কার্বন মার্কেট আসলে কোথায় বিদ্যমান?

বর্তমানে আসলে কোনো বৈশ্বিক কার্বন মার্কেট নেই। তবে আঞ্চলিক, জাতীয় এবং উপাঞ্চলিক পর্যায়ে ৬৮টি কার্বন মূল্যায়ন কর্মসূচি রয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে ২০২১ সালে বিশ্বের সবেচেয় বড় কার্বন বাজার চালু করেছে চীন। দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন’স এমিশন্স ট্রেডিং সিস্টেমকে (ইটিএস) ছাপিয়ে এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নির্গমনকারী দেশ। ইটিএস সমগ্র ইউরোপের ৪০ শতাংশ নির্গমনকে প্রতিনিধিত্ব করে।

ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় কি কার্বনের কোনো বাজার আছে?

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলি এখনও জাতীয় কার্বন বাণিজ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, যদিও এদের বেশিরভাগই এ বিষয়ে তাদের সম্ভাব্যতা অন্বেষণ করছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, পাকিস্তান একটি নির্গমন বাণিজ্য প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

ভারত একটি বিশাল কার্বন বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে, যদিও এটি প্রাথমিক পর্যায়ে, একটি দেশব্যাপী কার্বন বাণিজ্যের বাজার কীভাবে কাজ করবে সে সম্পর্কে বিশদ কোনো তথ্য নেই।

Gujarat Solar Park, India
ভারতের গুজরাটের একটি সোলার পার্ক। গুজরাট রাজ্য সম্প্রতি দেশের প্রথম কার্বন বাজারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে (ছবি: অ্যাশলে কুপার পিকস / এ্যালামি)

ভারতে বর্তমানে দুটি বাজার-ভিত্তিক নির্গমন হ্রাস প্রকল্প রয়েছে, যা হচ্ছে পারফর্ম, অ্যাচিভ এবং ট্রেড (পিএটি)  এবং নবায়নযোগ্য শক্তি সনদ (আরইসি)। পিএটি স্কিম তাপ শক্তি, সিমেন্ট, লোহা এবং স্টিলের মতো শক্তি-নিবিড় শিল্পগুলিতে শক্তি/জ্বালানী দক্ষতা লাভের জন্য পুরস্কৃত করে। এই সেক্টরের অপারেটররা তাদের শক্তি/জ্বালানী ব্যয় কমাতে লক্ষ্য নির্ধারণ করে।যদি তারা এই লক্ষ্যগুলি অর্জনে সক্ষম হয় তাহলে, তাহলে তাদের ক্রেডিট দিয়ে পুরস্কৃত করা হয় যা দিয়ে তারা ব্যবসা করতে পারে। আর নবায়নযোগ্য জ্বালানী/শক্তি সনদ প্রদানের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে  উৎপাদিত পরিচ্ছন্ন জ্বালানী/শক্তির পরিমাণের উপর ভিত্তি করে ক্রেডিট ক্রয় এবং বিনিময় করতে উৎসাহিত করা হয়। অবশ্য এই প্রক্রিয়াটি এখন পর্যন্ত সীমিত সাফল্য পেয়েছে, এবং ভারতের বেশিরভাগ রাজ্যে এটি তেমন সফলতার সাথে এখনও পর্যন্ত তেমনভাবে জনপ্রিয় হয়নি।

অতি সম্প্রতি, অপেক্ষাকৃত ধনী রাজ্য গুজরাট দেশের প্রথম সম্পূর্ণ কার্বন বাজার চালু করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, যা সফল হলে ভারতে কার্বন ব্যবসার জন্য একটি নীলনকশা হয়ে উঠতে পারে।

ভারত একটি সম্ভাব্য দেশব্যাপী কার্বন বাজার, যার বিস্তারিত  বিবরণ এখনো প্রকাশ করা হয়নি, যা এই পরীক্ষাগুলিকে প্রতিস্থাপন করবে।

কেন কার্বন বাজারের বিষয়টি বিতর্কিত?

সমালোচকরা মনে করেন যে কার্বন ট্রেডিং ধনী দেশগুলিকে তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস এড়িয়ে যেতে সহায়তা করে, তারা তাদের দূষণকারী কার্যক্রম বজায় রাখতে যতটুকু ক্রেডিট ক্রয় করা প্রয়োজন ততটুকু ক্রয় তরে থাকে।

যদিও বেশিরভাগ নীতি নির্ধারক এবং অর্থনীতিবিদেরা বায়ুমণ্ডলে কার্বনের ঘনীকরণ হ্রাসে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের উপরে একটি মূল্য নির্ধারণকে একটি যুক্তযুক্ত ব্যবস্থা হিসেবে মনে করলেও কার্বন মার্কেটের বিষয়টি এখনও যথেষ্ট অপরিপক্ক। যেমন মূল্য বেশি রাখার জন্য ক্রেডিট কম হওয়া প্রয়োজন।  ইইউ নির্গমন ট্রেডিং সিস্টেমটি ২০০৫৪ সালে চালু হওয়ার পরে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যর্থ হয়েছিল কারণ বাজারে প্রচুর কার্বন ভাতা ছিল। সময়ের সাথে সাথে, এই ক্রেডিটগুলির মূল্য ওঠানামা করেছে কারণ ইইউ তাদের প্রচলনকে আরও ভালভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে।

আরেকটি সমস্যা যা সরকারগুলো সমাধান করার চেষ্টা করছে তা হল কার্বন লিকেজ, এটি ঘটে মূলত যখন কোম্পানিগুলি তাদের দূষণকারী কর্মকান্ড অন্য দেশে নিয়ে যায় যেখানে কার্বন নির্গমন ঠিক সেভাবে অন্যান্য দেশের মতো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় না, তাই তাদেরকে উৎপাদিত দূষণ মোকাবেলায় নিজেদেরকে ক্রেডিট দিতে হয় না।  এই ঝুঁকি রোধ করার জন্য, ২০২১ সালে ইইউ কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম বা সিবিএএম অনুমোদন করে, যার অধীনে ইইউ আমদানিকারকরা তাদের নিজ ব্লকের বাইরে থেকে ক্রয় করা পণ্য থেকে কার্বন নির্গমনের খরচ নিশ্চিত করে, এবং এটি এমনভাবে করা হয় যেন তারা ইইউ নির্গমন ট্রেডিং সিস্টেমের অংশ। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলির বিশেষজ্ঞরা যারা ইইউতে কার্বন-ভারী পণ্য রপ্তানি করে তাদের মতে এটি তাদের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে যা প্রকৃতপক্ষে তাদের জ্বালানী/শক্তি পরিবর্তনের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অতি সম্প্রতি, ২০২২ সালের জুনে সিবিএএম ফ্রেমওয়ার্ক এবং ইইউ-এর নির্গমন ট্রেডিং সিস্টেমের একটি প্রস্তাবিত সংশোধন ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রত্যাখ্যান করে যা আবারো একটি বিতর্ককে পুনরুজ্জীবিত করে।

যখন অফসেটের কথা আসে, বৃক্ষ রোপন এবং বর্জ্যকে জ্বালঅনী/শক্তিতে রূপান্তর করার মতো প্রকল্পগুলির সাথে জড়িত অনেক প্রকল্পের কার্বন অপসারণের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কারণ এই ক্রিয়াকলাপগুলির কার্বন শোষণ করার ক্ষমতা পরিমাপ করা কঠিন এবং এর প্রতিটি কীভাবে প্রকল্পগুলো পরিচালিত হয় তার উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। এই সমস্যাগুলি তাদের উপর নির্ভরশীল ট্রেডিং সিস্টেমগুলির কার্যকারিতা হ্রাস করতে পারে।

কার্বন ব্যবসা সম্পর্কে প্যারিস চুক্তিতে কী বলা হয়েছে?

২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যেটি হচ্ছে সর্বাধিক বিতর্কিত ধারা ৬। এই ধারাটিতে বিশেষভাবে কার্বন বাজার সম্পর্কে বলা হয়েছে। চুক্তির অধীনে একটি সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে, দেশগুলির সংশ্লিষ্ট জলবায়ু লক্ষ্যগুলি পূরণের জন্য এটিকে তাদের একটি ‘স্বেচ্ছাসেবী সহযোগিতা’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

.

ছয় বছর পর, গ্লাসগোতে কপ২৬-এ দেশগুলি তাদের নির্গমন নিরীক্ষণ এবং অভিন্ন পদ্ধতিতে রিপোর্ট করার জন্য দেশগুলির জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ করে একটি ‘রুলবুক’ তৈরীর ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। রুলবুকটি দ্বিগুণ গণনার ঝুঁকিকেও সম্বোধন করে, যেটি ঘটতে পারে যদি একই হ্রাসকে বিক্রি করা এবং কার্বন ক্রেডিট ক্রয়কারী উভয়ের লক্ষ্যের বিপরীতে গণনা করা হয়।