জলবায়ু

তাপদাহ ও ​​বন্যার দ্বিমুখী সংকটের মধ্যে ভারত-বাংলাদেশের অভিযোজন ব্যবস্থায় অবহেলার বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্ট

তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বন্যার মতো বৈরী আবহাওয়ার ঘটনাগুলো দিন দিন বাড়ার প্রবনতা আমাদের চোখের সামনে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে, এর মধ্য দিয়ে ভারত এবং বাংলাদেশ যে অভিযোজনকে এখনও অবহেলা করছে সেটি খুব স্পষ্ট, আর এর জন্য চরম মূল্য দিতে হচ্ছে এ অঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র জনগণকে
বাংলা
<p>২০২২ সালের ২০ মে ভারতের আসাম রাজ্যের নাগাঁও জেলায় ভারী বৃষ্টিতে সুষ্ট বন্যার জলে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেখানকার কিছু বাসিন্দা। তীব্র তাপদাহ এবং বন্যার দ্বিমুখী সংকট ভারত ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব এবং অপ্রতুল পরিকাঠামোর অভাবের বিষয়টিই উঠে আসছে বার বার।  (ছবি: অনুয়ার হাজারিকা/এল্যামি)</p>

২০২২ সালের ২০ মে ভারতের আসাম রাজ্যের নাগাঁও জেলায় ভারী বৃষ্টিতে সুষ্ট বন্যার জলে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেখানকার কিছু বাসিন্দা। তীব্র তাপদাহ এবং বন্যার দ্বিমুখী সংকট ভারত ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় যথেষ্ট প্রস্তুতির অভাব এবং অপ্রতুল পরিকাঠামোর অভাবের বিষয়টিই উঠে আসছে বার বার।  (ছবি: অনুয়ার হাজারিকা/এল্যামি)

এই সাপ্তাহিক ছুটির মাঝে ভারতের উত্তরাঞ্চলে বৃষ্টির ফলে  তীব্র তাপপ্রবাহ থেকে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও বিষয়টি সাময়িক। কারণ আবারো তাপমাত্রা বাড়ার আভাস রয়েছে।  গত সপ্তাহে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে তাপমাত্রা সৌদি আরবের রিয়াদের তাপমাত্রার সাথে পাল্লা দিয়েছে এবং চলতি  সপ্তাহেই আবার তা আগের অবস্থায় যাওয়ার আভাস রয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের। একই সময়ে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য এবং প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে ভারী বর্ষণ ও বন্যার কারনে যথেষ্ট বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সেখানকার জনগণ।

জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সাথে দক্ষিণ এশিয়ায় একযোগে দুর্যোগের ঘটনাগুলো আরো বেড়েই চলেছে, অথচ সেই অর্থে বিবেচনায় একেবারেই অপ্রতুল। বন্যার কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির বেশিরভাগই অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বেড়েছে যা পরিবেশগত উদ্বেগ এবং স্থানীয় জনগণের চাহিদাকে উপেক্ষা করছে বলে এখন মেন করছেন অনেকেই।

নগরে সবুজায়নের পথে সংযোগ জলবায়ু, আর বাঁধা রাজনীতি

জলবায়ু পরিবর্তন এবং তাপ ও বন্যার দুটি সংকটের মধ্যে সংযোগ স্পষ্ট। আশ্চর্যজনকভাবে, যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস বলেছে যে, মানুষের প্রভাবে এপ্রিল-মে মাসের তাপমাত্রার অসামঞ্জস্যতা [উত্তর ভারত ও পাকিস্তানে] প্রায় ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে” এবং শতাব্দীর শেষের দিকে তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা বেড়ে বেড়ে গিয়ে এই অঞ্চলে প্রাকৃতিক অবস্থা থেকে ২৭৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে।

এমন পরিস্থিতিতে, কেউ মনে করতে পারে যে ভারত সরকার এসব মেকাকাবেলায় বড় ধরনের কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে। এমনকি এতটাই সচেষ্ট যে  – সরকার প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা বা পূর্বাভাস ব্যবস্থা করার পথে হাটছে। তবে সমস্যাটি হল তাপদাহ সংক্রান্ত সতর্কতা  পদক্ষেপ আরও দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থার নিষ্ক্রিয়তার দ্বারা হ্রাস পায়। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটির মতে, একটি মূল অভিযোজিত পরিমাপ হল শহরে ভূমি ব্যবহারের কৌশলের মাধ্যমে সবুজ অবকাঠামো, শীতল ছাদ, গাছ এবং গাছপালা, এবং সবুজ জায়গা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে তাপদাহের প্রভাব কমানো্ I

গত জানুয়ারী মাসে ভারতের পরিবেশ মন্ত্রী ভূপেন্দর যাদব, গর্বের সাথে ফরেস্ট সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে, দাবি করেন যে বনভূমির আচ্ছাদন বেড়েছে। তবে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে সমীক্ষাটি চা বাগান, কৃষির জন্য বনাঞ্চল, এবং সত্যিকারের বনভূমির মধ্যে এটি কোনো পার্থক্য করেনি এবং প্রকৃতপক্ষে সবুজ অঞ্চলে যে হ্রাস ছিল তা বৃদ্ধি হিসাবে দেখানো হচ্ছে। সরকারেরও শহুরে বনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ঘোষণা করার অভ্যাস রয়েছে যা বছরের পর বছর পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও কখনই দিনের আলো দেখে না। এটি আরও ভাল শহরগুলির জন্য অনেক পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যা বাস্তবায়িত হচ্ছে না

বন্যার ঘটনা বাড়ছে, তবে প্রস্তুতি যৎসামান্য

জলবায়ু পরিবর্তন এবং গত সপ্তাহে শুরু হওয়া বন্যার মধ্যে সংযোগও মোটামুটি পরিষ্কার। একটি বিবৃতিতে, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেছেন যে এই অঞ্চলে আর্দ্রতা ঘূর্ণিঝড় আসানির কারণে। ভারতের পূর্ব উপকূলকে হুমকি দেওয়ার পরে আসানি মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে বেরিয়ে আসে, কিন্তু সমুদ্র থেকে বৃষ্টির মেঘ ঠেলে দেওয়ার আগে নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘূর্ণিঝড়গুলি আরও ঘন ঘন এবং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে, সর্বনিম্ন নির্গমন পরিস্থিতিতে ভারতে বন্যার সম্ভাবনা ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে

এর প্রভাব অত্যন্ত মারাত্বক। আসাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বলেছে যে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যের ৩৩টি জেলার মধ্যে ২২টি ২২ মে বৃষ্টির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে ৭০০,০০০ এরও বেশি মানুষ এবং৯৫,০০০ হেক্টর ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২  জন মারা গেছে এবং ৯০,০০০ জনের বেশি মানুষ ইতিমধ্যেই সরকার পরিচালিত ত্রাণ শিবিরে রয়েছে।

সেতু, রেল লাইন এবং রাস্তাগুলি তলিয়ে গেছে বা ভূমিধসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা শুধুমাত্র আসামের কিছু অংশে নয়, এই অঞ্চলের অন্যান্য রাজ্য – ত্রিপুরা, মিজোরাম এবং মণিপুরের সাথে যোগাযোগকে বাঁধাগ্রস্থ্য  করেছে। বন্যার কারণে বিখ্যাত কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান সহ প্রাকৃতিক বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে এক শিংওয়ালা গন্ডারের বিশ্বের বৃহত্তম জনসংখ্যা রয়েছে।

ভারতে অনুপযুক্ত অবকাঠামোর ফলে বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব বেড়েই চলেছে

পরিস্থিতি এমনই এক জটিল আকার ধারণ করছে যাতে মনে হচ্ছে ক্রমাগত চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই ধরনের অবকাঠঅমোগত উন্নয়নে দেখা যায় অবকাঠােমার মান অত্যন্ত নিম্নমানের এবং তা অবশ্যই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ৈর বিষয়টি মাথায় রেখে করা হয় না।

উজানে অরুণাচল  এবং আসামে প্রদেশে অনেক বাঁধই অর্ধ-সমাপ্ত – যা শুধুমাত্র বন্যাকে আটকাতেই ব্যর্থ হচ্ছে না বরং  কখনও কখনও নদীগুলির মাধ্যমে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত করছে। বন্যা রোধ করার জন্য যে বাঁধগুলি ব্রহ্মপুত্র এবং এর উপনদীগুলিকে তাদের প্লাবনভূমি পর্যন্ত ধীরে ধীরে বিস্তৃত  করছে, আবার যখন বৃষ্টিপাত ভারী হয়ে যায় তখন বাঁধগুলি ভেঙে পড়ে। ব্রহ্মপুত্রের নাব্যতা বৃদ্ধি করার জন্য দুর্বল পরিকল্পিত ড্রেজিংয়ের কারনে নদীর তীরে পলির পিরমান বাড়ছে। প্রবল বর্ষণে বন্যার পানি এই পলিগুলোকে টেনে নিয়ে এখন গ্রাম ও বসতবাড়ি প্লাবিত হয়েছে।

আসামের ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে ভূমিধস মারাত্বকভাবে বেড়ে গেছে। এই অঞ্চলের অবস্থান এমন যে সেখানে  মেঘালয় মালভূমি নদীর দিকে ঢালু। মেঘালয়ের অনেক অংশে এবং আসামের কয়েকটি সংলগ্ন অংশে অবৈধ কয়লা উত্তোলনের ফলে খনি টেলিং দ্বারা নদীগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন, ভারী বৃষ্টিপাতের পরে, সেই নদীগুলির নীচে যে পানি প্রবাহিত হত তা পরিবর্তে পাহাড়ের ঢাল বরাবর মাটি আলগা হয়ে গেছে, যার ফলে অনেক ভূমিধসের ঘটনা বাড়ছে।

জলবায়ু বিপর্যয়ে বাংলাদেশও একই ধরনের নিষ্ক্রিয়তার শিকার

উল্লেখিত গবেষণায় দেখা যাচ্ছে  বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় এবং বন্যার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিও জলবায়ু পরিবর্তসের প্রভব মোকাবেলায় ধীর গতি এবং নিষ্ক্রিয়তার প্রমান দিচ্ছে।

আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে গিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন যে বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতের বর্তমান ধরণটি প্রাক বর্ষার ইঙ্গিত দিচ্ছে।  মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে, দক্ষিণ এশিয়ার মৌসুমী বায়ু দক্ষিণ শ্রীলঙ্কায় পৌঁছায় এবং এখন এটি নির্ধারিত সময়ের প্রায় এক সপ্তাহ আগে মূল ভূখণ্ডের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান দ্য থার্ড পোলকে বলেন, বন্যায় এখন পর্যন্ত ১০ লাখের বেশি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৬,০০০ পরিবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার খাদ্য ও চিকিৎসা সেবাসহ সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের কৃষকদের তাদের গ্রীষ্মকালীন ধান কাটার পরামর্শ দিয়েছে। যদিও এই ধান এখনই ঘরে তােলার মতো পরিপক্ক না। অন্যথায় ফসল প্লাবিত হয়ে বিনষ্ট হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্রহ্মপুত্রের প্রধান উপনদী তিস্তার চরে বসবাসকারীদের জন্য একটি আগাম সতর্কতা জারি করেছে। ভারী বর্ষনের ফলে ব্রহ্মপুত্র (বাংলাদেশে যমুনা বলা হয়) এবং পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার বাইরে যেতে শুরু করেছে।

দেশটির আবহাওয়াবিদ বজলুর রশীদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ভয়ঙ্কর খবর হল যে আমরা শীঘ্রই শুষ্ক আবহাওয়া দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের মডেলগুলো বিশ্লেষন করলে দেখা যাচ্ছে যে আরো অনেক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত আবহাওয়া এমনই থাকবে।

বাদ পড়ে যাচ্ছে কেবলই দরিদ্ররা

ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশেই নদী তীরবর্তী চরে বসবাসকারী জনগণ দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে প্রায়শই জনসংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে দরি। এসব এলাকায় সীমিত অবকাঠামোগুলো প্রায়ই ঘন ঘন বন্যা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর বছরের পর বছর ধরে এসব অঞ্চলের বাসিন্দারা ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকটের প্রভাবের যে কোনো উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিজেদের অনেকাংশেই পরিত্যক্ত মনে করে।

বাংলাদেশে, চর উন্নয়ন ও বাসস্থান প্রকল্প এবং চর জীবিকা উন্নয় কর্মসূচীর মতো অনেক প্রকল্পই সরকার এবং এনজিও দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। তবে এই প্রকল্পগুলি শুধুমাত্র অভিযোজন ব্যবস্থাপনা কেন্দ্রীক।

চলতি বছর খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি, ফসলের ক্ষতির দুশ্চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলছে। বর্তমান বৃষ্টিপাতের আগে ভারত ও বাংলাদেশে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং উভয় সরকারই ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য গ্রহণকারী লোকের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে বাধ্য হচ্ছে। ১ জুন থেকে, বন্যার আগে ঘোষিত একটি কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের ১ কোটি মানুষকে ভর্তুকিযুক্ত প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।