জলবায়ু

ব্যাখ্যা: কার্বন অপসারণ কিভাবে জলবায়ু বিপর্যয় প্রতিরোধ করতে সাহায্য করতে পারে

যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে বিশ্বব্যাপী কার্যকরভাবে নির্গমন হ্রাস করা গেলেও, বিশ্বকে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে উষ্ণতা বজায় রাখতে হলে বায়ুমণ্ডল থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস অপসারণ করতে হবে
বাংলা
<p>আইসল্যান্ডের হেলিশেইডি জিওথার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের একটি ইউনিট যা বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে মাটির নিচে পাঠিয়ে দেয় (রে ওয়াডিংটন / এ্যালামি)</p>

আইসল্যান্ডের হেলিশেইডি জিওথার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের একটি ইউনিট যা বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শুষে নিয়ে মাটির নিচে পাঠিয়ে দেয় (রে ওয়াডিংটন / এ্যালামি)

শুরু থেকেই প্রথাগতভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য যে সব নীতি প্রণীত হয়েছে তা কেবলমাত্র প্রশমনের বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে, যেমন –  গ্রীনহাউস গ্যাসের নির্গমন হ্রাস করা। এটি আসলে বলা যায় সেই অর্থে তেমন কাজ করেনি। আমরা যদি জাতিসংঘের পরিবেশ কার্যক্রমের সর্বশেষ এমিশন গ্যাপ রিপোর্ট পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে, যে প্যারিস চুক্তির সই করা দেশগুলো বিশ্বব্যাপী গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প স্তরের দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার যে প্রতিশ্রুতি করেছে তা পূরণে এখনও সফল হয়নি, হয়,তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করা থেকে অনেক দূরে রয়েছে, এক্ষেত্রে ১.৫সি এর মতো উচ্চাভিলাসী বিষয়ের কথা বলাই বাহুল্য।

যাইহোক, বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে নতুন নির্গমন যদি এখন বন্ধ হয়ে যায়, যা কার্যত অসম্ভব, কিছু পরিবেশগত পরিবর্তন ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যাবে এবং আগামী কয়েক দশকের জন্য বিসয়টি আরও প্রকট হয়ে উঠবে। এটি শুধুমাত্র কম কার্বন নির্গমন করার প্রয়োজনীয়তা বাড়ায় না, বরং বায়ুমণ্ডল থেকে যতটা সম্ভব অপসারণ করে।

কার্বন অপসারণ কী?

বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড অপসারণ পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্রেরই একটি অংশ হিসাবে ঘটে থাকে। মহাসাগর, মাটি, শিলা এবং গাছপালা সবই কার্বন শোষণ করে।

বনায়ন, বৃক্ষ বা গাছপালা পুনরুদ্ধার এবং উন্নত মাটি ব্যবস্থাপনা প্রাকৃতিকভাবে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন অপসারণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে অন্যান্য উচ্চ-প্রযুক্তি সম্পন্ন কৌশলগুলিও এক্ষেত্রে বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে।  সিসিএস, বা কার্বন ক্যাপচার এবং সংরক্ষণ, এমন একটি প্রক্রিয়া যা সরাসরি শিল্প কারখানা থেকে নির্গমনকে আটকে রাখে এবং গভীর ভূগর্ভে প্রতিস্থাপন করে।সিসিইউএস  বা কার্বন ক্যাপচার ব্যবহার এবং সঞ্চয়স্থান, কিছু পণ্য এবং পরিষেবার জন্য কার্বন ডাই অক্সাইড পরিবহন এবং ব্যবহারের কাজে জড়িত, যেমন অ্যালকোহল, জৈব জ্বালানি, প্লাস্টিক এবং কংক্রিট।

বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি বা আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে মাত্র ২৭টি সিসিইউএস প্রকল্প চালু রয়েছে। গ্লোবাল সিসিএস ইনস্টিটিউট এর তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায বাণিজ্যিক কোনো পূর্ণাঙ্গ বা কার্যকরী  সিসিএস প্রকল্প নেই।

বিইসিসিএস কি? কেন এটা বিতর্কিত?

জৈব পদার্থ বা বায়োমাস (কোনো নির্দষ্ট স্থানের সমগ্র জীবসমষ্টি) থেকে প্রাপ্ত শক্তির সাথে মিলিত হলে, সিসিএস  কার্বন- ঋণাত্বক হয়ে যায়। এর কারণ হল গাছপালা বড় হওয়ার সাথে সাথে শোষিত কার্বন ডাই অক্সাইড পুড়ে গেলে বায়ুমন্ডলে ফিরে আসে না। এই পদ্ধতিটি বিইসিসিএস  (কার্বন ক্যাপচার এবং স্টোরেজ সহ জৈব শক্তি) নামে পরিচিত এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু প্রশমনের জন্য একটি অপরিহার্য হাতিয়ার হিসাবে বিবেচিত হয়।

একটি কার্যকর এবং চলমান বিইসিসিএস-এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে কাঠের সাথে  কয়লা অদলবদল করা। নিষ্কাশিত গ্যাসের মধ্যে কার্বন ডাই অক্সাইড পৃথক করে পাইপার মাধ্যমে ভূগর্ভে পাঠানো হয় এবং তা পরে সংরক্ষণ করা হয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে,  কয়লার বিপরীতে, কাঠের টুকরোগুলো টেকসই ভিত্তিতে তৈরি করা যেতে পারে, যেমন বৃক্ষরোপন করে বৃহত গাছগুলোকে পরে জ্বালানি কাঠের মতো যেভাবে কেটে ফেলা হয়, সেভাবে।

তবে এই প্রযুক্তিটি এখনও বড় আকারে চালু করা যায়নি।  এখন পর্যন্ত, সারা বিশ্বে মাত্র পাঁচটি বিইসিসিএস সুবিধা রয়েছে। পাশাপাশি আরও চারটি স্থাপনের বিষয় পরিকল্পনা পর্যায়ে রয়েছে। বর্জ্য, জ্বালানী, এমনকি সিমেন্টের মতো অনেক শিল্প খাতে এর প্রয়োগের যথেষ্ট সম্ভাব্যতা থাকা সত্ত্বেও, প্রযুক্তিটি এখনও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা এখনও এই নিয়ে বিতর্ক করছেন যে খাদ্য উৎপাদনে কৃষি জমি ব্যবহার না করে টেকসইভাবে পর্যাপ্ত বায়োমাস তৈরি করা যেতে পারে, এবং যদি বিইসিসিএস   বিদ্যমান মডেলগুলির দ্বারা পরিকল্পিতভাবে বড় পরিসরে স্থাপন করা যায়।

কার্বন অপসারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো কী করছে?

আরও কার্বন সিঙ্ক তৈরি করতে বন সুরক্ষা করা এবং সবুজায়নের পরিসর বৃদ্ধি অনেক দেশের প্রশমন কৌশলগুলির নীতি হিসেবে চর্চা করা হচ্ছে। প্যারিস চুক্তির অধীনে নিজেদের জলবায়ু প্রতিশ্রুতির অংশ হিসাবে, ভারত “২০৩০ সালের মধ্যে অতিরিক্ত বন এবং সবুজায়ন বৃদ্ধির মাধ্যমে ২.৫ থেকে তিন বিলিয়ন টন  কার্বন ডাই অক্সাইড  সমতুল্য একটি অতিরিক্ত কার্বন সিঙ্ক তৈরি করার” প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাকিস্তান উচ্চাভিলাষী দশ বিলিয়ন বৃক্ষ রোপনের একটি সুনামি কার্যক্রম চালু করেছে, যা ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটের সাথে ১৪৮.৭৬ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্য সিকোয়েস্ট করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশনেপাল তাদের জলবায়ু প্রতিশ্রুতিতে উন্নত বন ও ভূমি ব্যবস্থাপনা অন্তর্ভুক্ত করেছে।

এখন পর্যন্ত সিসিএস প্রযুক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকটাই অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে, কারণ এটি অনেক ব্যয়বহুল। গবেষণায় দেখা গেছে যে ভারতের মতো মূল্য-সংবেদনশীল বাজারে, আইন প্রণেতাদের জন্য এমন পদ্ধতির প্রচার করা কঠিন হবে যা শিল্প প্রক্রিয়াগুলির ব্যয়কে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করবে।

আইপিসি কার্বন অপসারণের বিকল্পগুলি খুঁজে বের করবে

জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) দ্বারা সংকলিত ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের নতুন অধ্যায়, যা আগামী সপ্তাহে প্রকাশিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অন্যান্য তাপ-ট্র্যাপিং গ্যাসগুলি হ্রাস করার বিকল্পগুলি অন্বেষণ করবে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২১ সালের আগস্টে, বিশ্বের জলবায়ু বিজ্ঞানীরা যারা আইপিসিসি প্রণয়ন করেছেন তারা তাদের ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের ওয়ার্কিং গ্রুপ-১ তে বিশ্বব্যাপী গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের অবস্থা দেখেছেন। ওয়ার্কিং গ্রুপ-২  যার প্রতিবেদনটি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু করা হয়েছিল তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অভিযোজনের দৃষ্টিভঙ্গি দেখা হয়েছিল। এখন ওয়ার্কিং গ্রুপ – ৩ কার্বন নিঃসরণ কমাতে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন অপসারণের নীতির বিকল্পগুলি পরীক্ষা করবে।

যদিও সিসিএস প্রযুক্তিগুলি এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বিশ্বব্যাপী মূলধারায় পরিণত হয়নি, বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে ওয়ার্কিং গ্রুপ – ৩ এর রিপোর্ট এবং ভারত ও অন্যান্য দেশগুলির নেট-শূন্য প্রতিশ্রুতি কার্বন অপসারণ কথোপকথনে নতুন আশার পথ দেখাবে।