জলবায়ু

বাইডেনের জলবায়ু সম্মেলনের পর আশা ও নিরাশার যুগপৎ দোলাচালে এশিয়া

এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখে শেষ হওয়া বাইডেনের ডাকে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নিয়ে বিশ্বের কিছু নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একমত হয়ে নিজেদের নির্গমন মাত্রা হ্রাসের ঘোষণা দিলেও বিশ্লেষকরা বলছেন উচ্চাভিলাসী এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব, এরই মধ্যে অতিবাহিত হয়ে যাওয়া সময়সীমা এবং চীন-মার্কিন পারস্পরিক সহযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল
<p>লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ছবি: আলামী)</p>

লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (ছবি: আলামী)

লিডারস সামিট অন ক্লাইমেট চেঞ্জ নামক জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আহ্বানে বিভিন্ন দেশ থেকে ৪১ জন নেতা অংশ নেন। উচ্চ পর্যায়ের এই সম্মেলনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ে নির্গমন মাত্রা হ্রাসে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা প্রাক-শিল্প স্তরের চেয়ে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে প্রত্যেকেই তাদের উচ্চাভিলাসের কথা ঘোষণা করেন। একই সাথে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার একটি ক্ষেত্র রচনা করেন। 

সম্মেলনের আয়োজক ও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ নির্গমনকারী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০০৫ সালের তুলনায় নির্গমনের মাত্রা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে অর্ধেকে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়। সম্মেলনে অংশ নেয়া বিশ্বের নেতাদের বড় একটি অংশ একে স্বাগত জানালেও, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাইডেনের ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতির বিষয়টিকেও কিছুটা সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেন দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করেন  জলবায়ু ন্যায়বিচারের বিবেচনায় এই সহায়তা অপর্যাপ্ত। 

সম্মেলনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুষণ সৃষ্টিকারী দেশগুলোর মধ্যে উপস্থিত  ছিল চীন ও ভারত।  তাদের পক্ষ থেকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী শক্তি উৎপাদন বৃদ্ধির পথে জোরেসোরে অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কয়লা নির্ভর শক্তি উৎপাদন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) উদ্যোগের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব সবুজ জ্বালানী ব্যবহার ও উৎপাদনকে উৎসাহ প্রদান করার প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরেন। কিন্তু বিআরআই প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে কয়লা-নির্ভর বিদ্যুত উৎপাদনে অর্থায়ন বন্ধের বিষয়ে কোনো ধরনের সুষ্পষ্ট বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত থাকেন তিনি। এদিকে কবে নাগাদ নেট-জিরো লক্ষ্যমাত্রায় (কার্বন নির্গমনের মাত্রা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শুন্যের কোঠায় নিয়ে আসা) পৌছানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে সে ব্যাপারে কোনো দায়িত্বশীল বক্তব্য প্রদানে নিরস্ত ছিল ভারত। তবে আশার বাণী বলতে তারা যেটুকু শুনিয়েছে তা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি ৪৫০ গিগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন নবায়নযোগ্য বিদ্যুত উৎপাদন অবকাঠামো স্থাপনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সব দেশগুলোকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নির্গমনের মাত্রা কমিয়ে আনার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করলেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বেশি দূষণসৃষ্টিকারী দেশগুলোসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির শিকার হওয়া অন্যান্য দেশ এর সঙ্গে জীবন-জীবিকা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যোগসূত্র বোঝার আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দ্য থার্ড পোলের পক্ষ থেকে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেয়া প্রতিনিধি দেশগুলোর বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে জানতে চাওয়া হয় যে এই সম্মেলন থেকে উৎসারিত নানা প্রতিশ্রুতি ও উদ্যোগের বিশ্লেষণে আগামীর দশকগুলোতে তারা এখন কি ধরনের আশা ও সহযোগিতার সম্ভাবনা দেখছেন।

উল্কা কেলকার

ডিরেক্টর অব ক্লাইমেট প্রোগ্রাম, ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইন্সটিটিউট ইন্ডিয়া

প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আহ্বানে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন থেকে আসা ঘোষণাগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো এমন একটি সময়ে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপিত হলো যখন সারা পৃথিবী একটি ভয়াবহ অতিমারী ও অর্থনৈতিক দুর্যোগে পর্যুদস্ত।  এক বছর আগেও যখন আমরা এই অতিমারীর প্রথম ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম তখনও আমরা জানতাম না যে এর ফলে যে অভুতপূর্ব অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন হয়েছে তা কাটিয়ে উঠার স্বার্থে হয়ত আমাদের জলবায়ু মোকাবেলায় গৃহীত নানা কার্যক্রমকে ত্যাগ করতে হতে পারে। তবে এমন একটি সময়ে এই ধরনের একটি সম্মেলন একটি ভগ্ন আশাকে পুনর্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এই সম্মেলনের মাধ্যমে আবারো জানতে পারলাম যে এতে অংশ নেয়া সকল দেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলাসহ সর্বোপরি প্যারিস চুক্তিতে গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পক্ষে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা পূনর্ব্যক্ত করেছে।  যদিও সম্মেলনে ব্যক্ত করা সকল ঘোষণারই বাস্তবায়ন হতে হয়ত পরবর্তী এক দশক বা তার চেয়েও বেশি সময় লেগে যেতে পারে, তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ছিল তা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কার্বন নির্গমন হ্রাসের প্রতিশ্রুতি। দেশটির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমনের মাত্রা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে তা থাকবে একেবারেই শূণ্যের কোঠায়। আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী সবচেয়ে বড় দেশ হিসেবে বৈশ্বিক জলবায়ু মোকাবেলা সংক্রান্ত কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় অংশগ্রহনের বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য এক্ষেত্রে কেবল বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে থাকেনি। তারা এই প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এরই মধ্যে আইনেরও যুগোপযোগী পরিবর্তন এনেছে যা আসলে অন্যান্য অনেক দেশের জন্য নিংসন্দেহে অনুকরণীয়। সম্মেলনে যেসব আর্থিক প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে তা বাস্তবতার নিরিখে অত্যন্ত নগণ্য। সম্মেলনে ভারত জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তার চলমান অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির কথা পুনরাবৃত্তি করেছে। আর অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা দিয়েছে তারা একটি নতুন ক্লাইমেট অ্যান্ড ক্লিন এনার্জি এজেন্ডা ২০৩০ পার্টনারশীপ বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশসম্মত বিশুদ্ধ প্রযুক্তি স্থাপনে বিনিয়োগ সংগ্রহ করবে।

লিউ ইউয়ানলিং

অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চার, ইন্সটিটিউট অব আমেরিকান স্টাডিজ, চায়নিজ একাডেমি অব সোশ্যাল সাইন্সেস

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সহযোগিতা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার মতো কঠিন কাজে সফলতা আসবে না। দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়কে নতুন করে ঝালিয়ে নেয়ার মতো ঘটনা সকলের জন্যই একটি ইতিবাচক বার্তা বয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। গ্রিনহাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণ সক্ষমতা আরো জোরদার করার লক্ষে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র কিগালি সংশোধন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছে। এর মাধ্যমে সারা বিশ্বে এক ধরনের বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়েছে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কঠিন একটি সময় পার করছি। কিন্তু একথাও সত্য যে দুই পক্ষের মধ্যে নানা সহযোগিতার ক্ষেত্রে রয়েছে বড় বড় চ্যালেঞ্জ। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের হাতে যে সময় রয়েছে তা কেবলই চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রেও রয়েছে ভিন্নতা, যেমন পারস্পরিক সমঝোতার অভাব, নানা অসম পদক্ষেপ, অর্থায়ন এবং সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের ধরণ। ক্ষমতার পালা বদলে জো বাইডেনের দায়িত্ব গ্রহনের পরেও দুদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন এখনও দৃশ্যমান নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো একটি বিষয় দীর্ঘদিন ধরেই এক প্রকার রাজনীতিকীকরণের মধ্যে দিয়ে গেছে এবং এটি এখন রুগ্ন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের কারনে স্বাভাবিকভাবেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে। এই বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য দুদেশের মধ্যে প্রতিভাবান তরুণ উত্তরসূরীও অভাব রয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার জলবায়ু সহযোগিতা নিয়ে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন শি ঝেনহুয়া ও জন কেরী, যাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে রয়েছে অদম্য আগ্রহ, উদ্দীপনা।  জলবায়ু ইস্যু নিয়ে কাজ করা এই নেতাদের জন্য এক প্রকার মিশন বলেই অনেকে মনে করেন। ভবিষ্যতে এদের মতো আগ্রহ ও উদ্যম নিয়ে এই বিষয়ে কাজ করার মতো নতুন নেতৃত্ব এগিয়ে আসবে কি না তা এখনও অনিশ্চিত।

জিন স্যু

ডিরেক্টর, এনার্জি জাস্টিস প্রোগ্রাম, সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি, যুক্তরাষ্ট্র

আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ও ব্যাপকতার তুলনায় অভ্যন্তরীণ নির্গমনের মাত্রা যে পর্যায়ে কমিয়ে আনা প্রয়োজন তার তুলনায় প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অভ্যন্তরীণ নির্গমনের মাত্রা ৫০ – ৫২% পর্যন্ত  কমানোর প্রতিশ্রুতি একেবারেই নগন্য।  জলবায়ু দুর্যোগের প্রকৃষ্ট সমাধান করতে হলে অবশ্যই বিজ্ঞান ও সমতার যৌগিক প্রয়োগ করতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় দূষণ সৃষ্টিকারী দেশ এবং বিশ্বের মধ্যে অন্যতম ধনী রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ন্যায়ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশটির উচিত আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে অবশ্যই স্থানীয় নির্গমন মাত্রা কমপক্ষে ৭০% হ্রাস করা এবং একই সাথে নিজের জলবায়ু ঋণের অংশ হিসেবে কার্বন নির্গমন মাত্রা কমিয়ে আনতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা করা। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবেলায় আমাদের সার্বিক অর্থনৈতিক অবকাঠামোর আমূল পরিবর্তন করে অবিলম্বে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার শূন্যের কোঠায় আনতে হবে। সেই সাথে আমাদের উচিত নবায়নযোগ্য ও বর্ণবাদ-বিরোধী জ্বালানী ব্যবস্থার প্রচলনের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের পথ সূগম করা।

নভরোজ দুবাস 

অধ্যাপক, সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ, ভারত

জলবায়ু সম্মেলনে উল্লেখ করার মতো একটি পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেল। তা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নানা পদক্ষেপের সিদ্ধান্তসহ দীর্ঘমেয়াদে শূন্য-নির্গমন নীতি বাস্তবায়নের বিষয়টির রাজনৈতিক ঐক্যমত। আমার মতে এটি একটি ভালো লক্ষণ, কারণ ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তার সঠিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের চাপ এখনই বোধ করাটা হয়ত ঠিক হবে না। এই পরিবর্তনের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় স্বল্পমেয়াদী নীতিমালা গ্রহন এবং দীর্ঘমেয়াদে লক্ষ্য নির্ধারণ একে অপরকে আরো বেগবান করতে সহায়ক হবে। যেসব দেশ এখন তাদের আগের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলোর পূনর্মূল্যায়ন করছে তাদের উচিত এখনই পরিস্কার এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সমূদয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কর্মপন্থা নিরুপণ করা। পাশাপাশি  ঘোষিত জলবায়ু প্রতিশ্রুতিগুলো যাতে কোনোভাবেই দেশের জাতীয় রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে না যায় সে বিষয়টিও নিশ্চিত করা। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা কারণ দেশটিতে  জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আইন প্রনয়নের বিষয়টি এখনও অনিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে।

আর ভারতসহ যেসব দেশ তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো এখনও পুনর্বিবেচনা করেনি তাদের জন্য এ মুহুর্তে যেটি করণীয় তা একেবারেই পরিস্কার;  স্বল্পমেয়াদী কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অর্থাৎ শূণ্য-নির্গমন লক্ষ্যমাত্রায় পৌছানোর বাস্তব রোডম্যাপ এবং সেই লক্ষ্যে পৌছানোর প্রক্রিয়া হিসেবে পরিস্কার ও বিশ্বাসযোগ্য নীতি প্রনয়ন করা। ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেরই এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অবকাঠামো নেই। তাই এসব দেশের জন্য সম্ভবত এই মুহুর্তে প্রথম অগ্রাধিকার হবে প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরি করা।  ভারতের সামনে এমুহুর্তে তিনটি প্রধান অগ্রাধিকার, প্রথমত, আমাদের প্রধান সেক্টরগুলোতে উন্নয়ন পরিকল্পনায় পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিস্কার ও বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে সবার আগে প্রয়োজন বিদ্যুত সেক্টরের পরিবর্তীত উন্নয়ন পরিকল্পনা। এই ধরনের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে উন্নয়ন সংশ্লিষ্ট উপযোগের বিষয়গুলো যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এবং স্থানীয় পর্যায়ে বায়ু দূষণ রোধ ও কার্বন নির্গমনের মাত্রা নির্ধারণ। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুত নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভারতের এখনই কয়লা বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতার রাশ টেনে ধরতে হবে এবং তার পরিবর্তে এখন জাতীয় গ্রীডের উন্নয়নের পাশপাশি জোর দিতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জনের দিকে। কিন্তু এটি করতে হলে দেশের যেসব রাজ্য এখনও কয়লা-নির্ভর বিদ্যুতের উপরে নির্ভরশীল সেখানকার জন্য অবিলম্বে একটি রুপান্তর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট খাত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যসমূহের সাথে এই পরিকল্পনার সমন্বয়ে ভারতের এখনই উচিত একটি স্বাধীন পরামর্শক সংস্থা বা কমিটি গঠন করা। এর উদ্দেশ্য হবে অদূর ভবিষ্যতে একটি স্বল্প-কার্বন অর্থনীতি গঠনে জনমত গড়ে তোলা।

ঝোউ জি

প্রেসিডেন্ট, এনার্জি ফাউন্ডেশন, চীন

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে আমরা রাষ্ট্রপতি ওবামার সময়কালীন যে সহযোগিতর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে অবস্থায় আবারো ফিরে যেতে সক্ষম হবো।  সেই সময়ে উভয় নেতার পক্ষ থেকে কিছু যৌথ বিবৃতি প্রদান করা হয়েছিল। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র যদি আন্তরিক ও ব্যবহারিকভাবে সহযোগিতার দ্বার আবারো উন্মোচন করে, তবে দুদেশের শীর্ষ নেতার পর্যায় থেকে আবারো যৌথ বিবৃতি আসতে পারে। আর সেটি করা গেলে নির্দিষ্টকরণ, সক্ষমতা ও অন্যদের মধ্যে উৎসাহ সৃষ্টির পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

পৃথিবীর অন্যতম বড় অর্থনীতির এই দুটি দেশই জীবাশ্ম জ্বালানী অর্থাৎ কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবারই প্রথমবারের মতো পরিস্কারভাবে তারা যৌথ বিবৃতিতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ধরণগুলো লীপিবদ্ধ করেছে। এ মুহুর্তে চীনের উচিত কয়লার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা। পাশাপাশি জ্বালানী বা বিদ্যুত উৎপাদন খাতে আনুপাতিকহারে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহার শুরু করা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমানোর বিষয়টি অনেকটাই দ্বান্দ্বিক। সময় এসেছে এখন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার হ্রাস ও নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে সহযোগিতার পথ প্রসারিত করার।

শাহাব এনাম খান

অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এমুহুর্তে চলার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগসড়কে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে এখানকার সরকারগুলোর মনোভাব যদি প্রাক কোভিড-১৯ সময়ের মতোই থাকে তাহলে কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বে সরকারগুলোকে হয়ত নতুন বা অপ্রচলিত সমস্যার মোকাবেলা করতে হতে পারে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে এই দেশগুলোকে এখন একপাক্ষিকভাবে নিজেদের কাজের ফিরিস্তি দেয়ার মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ মুহুর্তে একটি স্থায়িত্বশীল টেকসই জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারগুলোর উচিত পানি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে সমুদ্র বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতার পরিবেশের চর্চা শুরু করা। কার্বন ভিত্তিক শক্তি ব্যবস্থা থেকে নবায়নযোগ্য ও উদ্ভাবনী জ্বালানী অবকাঠামোর পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সাহসী ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। আগামী দশকগুলোতে বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনোমিক কো-অপারেশন) এবং সার্কের (দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) আওতায় গৃহীত আঞ্চলিক সহযোগিতার নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে।  (সার্কভূক্ত দেশগুলোর) রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অনুধাবন করতে হবে যে জলবায়ু পরিবর্তন এখন আর কোনো আমলাতান্ত্রিক রাজনীতির বিষয় নয়। এটি এখন আমাদের সবার অস্তিত্বের জন্য হুমকি যার সমাধানে প্রয়োজন নির্গমনমাত্রা কমিয়ে এটিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার মতো বাস্তবমুখী পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি।

ফাহাদ সাঈদ

আঞ্চলিক জলবায়ু বিজ্ঞানী, ক্লাইমেট এনালিটিকস, পাকিস্তান

আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গমন মাত্রা যথেষ্ট পরিমানে কমিয়ে আনার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জোর প্রতিশ্রুতির বিষয়টিকে আমরা অত্যন্ত স্বাগত জানাই। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে এর আগের মার্কিন প্রশাসনের সময়ে চার বছরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়েছে। এটি ভাবার মতো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কারণ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন না করে সময় ক্ষেপন করা মানে হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আরো জটিল আকার ধারন করবে এবং এজন্য সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। আমরা তাই মনে করি যে সময় এরই মধ্যে যে সময় নষ্ট হয়েছে যত দ্রত সম্ভব তার রাশ টেনে ধরে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জলবায়ু অর্থায়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের সার্বিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকা এক শতাংশের কম হলেও জলবায়ু পরিবর্তন এই দেশটির জন্য একটি উচ্চ অগ্রাধিকারভিত্তিক এজেন্ডা। অনুকরণীয় ১০ বিলিয়ন বৃক্ষ বনায়ন প্রকল্পের পাশাপাশি পাকিস্তানের এখন উচিত যথোপযুক্ত নীতি এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুত/জ্বালানী খাতে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে উন্নিত করা। গবেষণায় দেখা গেছে নবায়নযোগ্য জ্বালানীতে  রুপান্তরের মধ্য দিয়ে নতুন কর্মসংস্থান, উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং আমদানী বিল হ্রাসসহ অফ-গ্রিড বিদ্যুত সরবরাহের মতো অনেক সুবিধার পথ সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে অবশ্যই অতিতের সব প্রযুক্তি পরিত্যাগ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানীর যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে সেই পথে এখন পাকিস্তানকে অগ্রসর হতে হবে।

বারবারা ফিনামোর

এশিয়া বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক, ন্যাশনাল রিসোর্সেস ডিফেন্স কাউন্সিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

কয়লা ভিত্তিক শক্তি উৎপাদন প্রকল্প শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণসহ ১৪তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কয়লার ব্যবহার অভাবনীয় পর্যায়ে হ্রাস করার যে প্রতিশ্রুতি প্রেসিডেন্ট শি দিয়েছেন তা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহনের মধ্য দিয়ে চীনের এখন যেসব কার্যক্রম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে হবে তা হচ্ছে: ১) সকল কয়লা-ভিত্তিক প্রকল্প স্থগিত করা, ২) চলমান প্রকল্পগুলো স্থায়িভাবে বন্ধ করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ, এবং ৩) কয়লা ব্যবহার এবং কার্বন নির্গমন সম্পূর্ণরুপে বন্ধ করা। দক্ষিণ কোরিয়া ঠিক যেভাবে বিদেশে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পে বিনিয়োগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে, চীনেরও উচিত সেই পথ অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে বিদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীন তার অভ্যন্তরীণ জলবায়ু উচ্চাশা ও নীতির প্রতিফলন ঘটাতে পারে। বরং নবায়নযোগ্য জ্বালানী ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্বের একটি সফল দেশ হিসেবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সবুজ ও স্বল্প কার্বন উন্নয়নের পথকে আরো ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে চীন প্রভূত ভূমিকা রাখতে পারে।