icon/64x64/climate জলবায়ু

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় বাড়ছে পানির তীব্র সংকট

স্যাটেলাইট (ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র) থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে , নগন্য পরিমানে বৃষ্টিপাত এবং অধিক উঞ্চ আবহাওয়ার কারনে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল অঞ্চলগুলোতে ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট দিনকে দিন আরো ঘনীভূত হচ্ছে

গত প্রায় দুই দশক ধরে সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের পরিমান একেবারেই কমে গেছে। এর ফলে বিশ্বের অন্যতম জনবহুল ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ্য এই অঞ্চলে সার্বিকভাবে পানির  সংকট তীব্রতর হচ্ছে বলে নতুন এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

এই ধরনের প্রাকৃতিক ও জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে এই অববাহিকায় বসবাসরত ৭০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন-জীবিকার উপরে মারাত্বক হুমকি নেমে আসতে পারে। কারন এই বিপুল সংখ্যক মানুষের একটি বিরাট অংশ কৃষি, বনভূমি, মৎস এবং গবাদী পশু লালন পালনের জন্য এই পানির উপরে সরাসরিভাবে নির্ভর করে থাকে।

ভারতে সরকারী সংস্থা ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) রুরকি এবং গোয়ার ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান অ্যান্ড পোলার রিসার্স-এর বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি স্যাটেলাইট প্রযুক্তির মাধ্যমে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সালের তথ্য ব্যবহার করে বৃষ্টিপাতের ধরনে কী ধরনের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে এবং সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকার ভূ-গর্ভস্থ এবং ভূ-উপরিস্থিত পানির সার্বিক উপস্থিতির অবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করেছেন।

এই গবেষণাটির সাথে যুক্ত বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া এবং তাপমাত্রা অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের এই অববাহিকার পানির মজুদ মারাত্বকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে এই অঞ্চলের মানুষ খুব শীঘ্রই দীর্ঘমেয়াদী পানির সংকটে পতিত হবে।

রুরকি ও গোয়ার বিজ্ঞানীরা এখানকার মাসিক ও ঋতুভিত্তিক বৃষ্টিপাতের প্রকৃতি বা ধরণ বুঝতে ১৯৯৮ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন। এর আগে অবশ্য এ ধরনের কিছু গবেষণা হয়েছে তবে তা ছিল এই অববাহিকার বিভিন্ন এলাকার বাৎসরিক ও ঋতুভিত্তিক বিশ্লেষণ। এইবারই প্রথম রুরকি ও গোয়ার বিজ্ঞানীরা সিন্ধ-গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকার সমগ্র এলাকার পানির প্রাপ্যতার পরিমান বিশ্লেষণ করেন।

তাদের এই গবেষণায় দেখা গেছে এই অববাহিকা জুড়ে ০.০২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রতি বছর বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বার্ষিক পানির পরিমান হ্রাস পাওয়ার ছিল ১২.৬ মিমি। অর্থাৎ প্রতিবছর এই অববাহিকায় পানির সার্বিক পরিমান থেকে ১২.৬ মিমি করে হ্রাস পেয়েছে।

অঞ্চলভেদে তারতম্য

আইআইটি রুরকির গবেষক এবং এই গবেষণার একজন লেখক আকাংক্ষা প্যাটেল দ্যথার্ডপোলকে বলেন, এই অববাহিকায় যে পরিমান পানির মজুদ রয়েছে তা আসলে এখানে সংঘটিত বার্ষিক বৃষ্টিপাত ও বরফের পরিমানের পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। স্থানভেদে এই পরিবর্তনের ধরনেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

তাদের এই গবেষণায় দেখো গেছে এই অববাহিকার পূর্ব পাশে অর্থাৎ গঙ্গা ও ব্রক্ষ্মপুত্র নদী অববাহিকায় পানিসম্পদ হ্রাস পেয়েছে এবং পশ্চিমদিকে অর্থাৎ সিন্ধু নদীর অববাহিকা অঞ্চলে পানিসম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঐতিহাসিক প্রবণতা

ভারতে পানির সংকট নিয়ে আগে থেকেই যে সরকারের যে একটি সতর্কবার্তা ছিল এই গবেষণাটি আসলে সতর্কবার্তাকে আরো সুসংহত করেছে। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া (এনআইটিআই আয়োগ) ভারতের একটি জাতীয় থিংক ট্যাংক। এই সংস্থাটির ২০১৮ সালের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়েছিল ভারত তার ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় পানির সংকটে ভূগছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সংকটের কারনে হুমকির মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ ভারতে মারাত্বক পানির সংকটে ভুগে থাকে এবং প্রায় ২০০,০০০ মানুষ প্রতিবছর সুপেয় পানির অভাবে মারা যায়। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের পানির চাহিদা বর্তমান সময়ের চেয়ে দ্বিগুন বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ তীব্র পানির সংকটের  মুখে পতিত হবে।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের জন্য একটি পানি ব্যবস্থাপনা সূচক (ইনডেক্স) তৈরি কেরেছে এনআইটিআই আয়োগ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজ্যগুলোর পানি বব্যবস্থার উন্নয়ন। এই সূচকে ভারতের যে রাজ্যগুলো নিচের দিকে অবস্থান করছে সেগুলো হচ্ছে দেশটির উত্তর দিকের রাজ্য বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং হারিয়ানা। এর সবগুলোই কিন্তু গঙ্গা অববাহিকার অন্তর্গত।

Since 1998, annual rainfall in Indus, Ganga and Brahmaputra basins has shown an overall declining trend

১৯৯৮ সাল থেকে সিন্ধু, গঙ্গা ও ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকায় সার্বিক বৃষ্টিপাতের পরিমান হ্রাস পেয়েছে

গবেষণার ফলাফল নিয়ে বিতর্ক

নতুন এই গবেষণার ফলাফল বেশ চমক থাকলেও কিছু কিছু বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলছেন ভূমিতে কী পরিমান পানির সরাবরাহ আছে তা বিশ্লেষণ না করে কেবল স্যাটেলাইট তথ্য বিশ্লেষনের মাধ্যমে এই ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া একটি পরোক্ষ মূল্যায়ণ পদ্ধতি। এই গবেষণার আরো একটি নেতিবাচক দিক হচ্ছে এতে বরফ বা বৃষ্টিপাত থেকে ভূ-গর্ভে বা ভূ-উপস্থিত পানির উৎসে কী পরিমান পানি যুক্ত হচ্ছে তা বলা হয়নি। এমনকি পানির গতি প্রবাহের ফলে কী পরিমান পানি নষ্ট হচ্ছে তাও বলা হয়নি।

ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্ট-এর (আইসিআইএমওডি) আঞ্চলিক কর্মসূচি ব্যবস্থাপক অরুণ শ্রেষ্ট বলেন, আইসিআইএমওডি-ও গবেষণা মতে, সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রক্ষ্মপুত্র (আইজিবি) অববাহিকায় পানির প্রাপ্যতা ২০৫০ সাল নাগাদ বৃদ্ধি পেতে পারে। এর কারন হিসেবে তিনি বলেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বরফ গলে এবং অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে সিন্ধু অববাহিকার পানির সংস্থান বৃদ্ধি পাবে।

সিন্ধুর উজানে  ২০৫০ সাল নাগাদ পানির প্রবাহ হয় বাড়তে পারে অথবা হ্রাস পেতেও পারে (-৫% থেকে +১২% পর্যন্ত পরিবর্তন হতে পারে), গঙ্গার উজানে এই পরিবর্তন ২০০৫ সালের মধ্যে ১-২৭% পর্যন্ত বাড়তে পারে এবং ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকার উজানে এই পরিবর্তন ১৩ শতাংশ হতে পারে। আইসিআইসিএমওডির গবেষণা দলটির মতে, ২০৪১ সাল থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে এই অববাহিকায় পানির পরিমান বৃদ্ধি পাবে এবং সেটি ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সালের যে প্রবাহ ছিল তার চেয়ে বেশি হবে বলে ধারণা করছে এই গবেষণা দলটি।

১৯৮১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রেকর্ডকৃত প্রবাহের তুলনায় আইজিবি অববাহিকায় স্বল্পমেয়াদে (২০৩৫ – ২০৬৪) এবং দীর্ঘমেয়াদে ২০৭৫ – ২১০০ সালে পানির গড় প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে। এর কারন হিসেবে তিনি চিহ্নিত করেন অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি।

অরুন শ্রেষ্ঠ বলেন, পানির যোগানের বিষয়টি একটি অত্যন্ত জটিল সমীকরনের উপরে নির্ভরশীল। এর সঙ্গে বৃষ্টিপাত, বরফ জমাট বা গলা এবং পানির সার্বিক ব্যবহারের মাত্রা ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এই অববাহিকায় হিমবাহের পরিবর্তন এবং ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত মৌসুমী আবহাওয়ার কারনে বৃষ্টিপাতের তারতম্য এখানকার পানির প্রাপ্যতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে।

অভিযোজনের জন্য তথ্যউপাত্ত

সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আসন্ন সংকট মোকাবেলায় নানা ধরনের অভিযোজন ও প্রশমন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহনে নতুন এই গবেষণার দিকনির্দেশনা যথেষ্ট কজে আসবে। তাদের মতে, বৃষ্টিপাতের ধরনের ব্যাপারে অধিকতর বোধগম্যতা একটি টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পাওে বলে মনে করা হচ্ছে।

ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার

এই অঞ্চলের পানির সংকটের অন্যতম মূল কারণ হচ্ছে কৃষিকাজে পানির অস্বাভাবিক এবং মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনলজি কানপুরের আর্থ সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক রাজীব সিন্হা বলেন, কৃষি ক্ষেত্রে কীভাবে পানির ব্যবহার করা হবে সেটির উপরে পানির সার্বিক সংরক্ষণের বিষয়টি নির্ভর করে। উদাহলণ হিসেবে তিনি বলেন, দেখুন ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য পাঞ্জাব ও হারিয়ানায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাপক সংকট দেখা যায়। কারন এই দুটি রাজ্য ভারতের সবুজ বিপ্লবের একদম কেন্দ্রে অবস্থান করে।   ১৯৬০ সালে দেশে উচ্চ ফলনশীল গম ও ধান উৎপাদন প্রচলণ করা হয় যাতে প্রচুর পরিমানে সেচ ও সারের প্রয়োজন হয়।

গত আগষ্টে ন্যাচার সাইন্টিষ্ট রিপোর্ট প্রতিবেদনে অধ্যাপক সিন্হাসহ আরো বেশ কয়েকজন লেখক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন যে উত্তর-পশ্চিম ভারতে কেবল কৃষি কাজে অধিক সেচের মধ্য দিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানির সংকট তৈরি হয়।

কম্পিউটার সিম্যুলেশন ব্যবহার করে দেখা গেছে আগামী ২০২৮ পর্যন্ত যদি এই গতিতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার অব্যাহত থাকে তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিবছর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর  ২.৮ মিটার করে হ্রাস পেতে পারে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পানির ব্যবহার প্রতিবছর ২০ শতাংশ হারে কমিয়ে আনা গেলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাসের হার ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে আসবে।

ভূগর্ভস্থ পানির পরিমান বৃদ্ধির উপায়

অধ্যাপক সিন্হা বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে বার্ষিক তারতম্যের প্রবণতার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ পরিবর্তন এসেছে। আগে আমরা দেখতাম মৌসুমী বৃষ্টিপাতের পরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর বৃদ্ধি পেত। কিন্ত ২০০ সালের পর থেকে এই স্তরে আর বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছেনা।

অধ্যাপক সিন্হা বিহারের বেশ কিছু অঞ্চলে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। ভারতের এই রাজ্য দিয়ে গঙ্গা নদী প্রবাহিত হয়।  তিনি ২০০৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিহারের বিভিন্ন জেলায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পরিমাপ করে দেখেন। তিনি দেখতে পান যে বর্ষার আগে এবং পরে সবসময়ই ওই সব জেলায় ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ২ – ৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।

এ মুহুর্তে ভারতের উচিত ভূ-গর্ভস্ত পানির স্তর বৃদ্ধিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করা। অধ্যাপক সিনহা বলেন, বিভিন্ন ধরনের পুকুর, বাঁধ অথবা সরাসরি ভূ-গর্ভের পানির বিভিন্ন উৎসে বাইরে থেকে সরাসরি পানি প্রবেশ করিয়ে (ইনজেক্ট) দেখা যেতে পারে। এছাড়াও ভবিষ্যতে পানির সংকট এড়াতে ভারতকে এখন তার কৃষি ব্যবস্তা যেমন সেচ ব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

অনুবাদ: আরিক গিফার

একটি মন্তব্য যোগ করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.