icon/64x64/climate জলবায়ু

ছবিতে ঘূর্ণিঝড় আম্পান পরবর্তী বাংলাদেশের মানুষের দু:সহ জীবনের গল্প

ঝড়ের তোড়ে ভেসে গেছে ঘর, সঙ্গে জীবন-জীবিকা। আর তাই ঘূর্ণিঝড় আম্পান পরবর্তী সময়ে কোনো রকমে টিকে থাকার সংগ্রাম করছেন অনেকেই, কেউ আবার ভবিষ্যতের অজানা আশংকায় বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অন্যত্র

ছয় সদস্যের পরিবারের প্রধান সাহিল উদ্দিন মোড়ল (৫৭), পেশায় একজন দিনমজুর। বাড়ি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা সাতক্ষীরার কুড়িখানিয়া গ্রামে। কাজ করতেন সেখানকার চিংড়ির খামারে, বলতে গেলে তার আয়েই চলত সংসার। গত মে মাসে প্রলংয়কারী ঘুর্ণিঝড় আম্পান ভাসিয়ে নিয়ে ছোট্ট ক‚ড়েঘরটি, তাদের ছয় সদস্যের পরিবারের মাথা গোঁজার একমাত্র আশ্রয়স্থল। সবকিছু লন্ড-ভন্ড করে দেয়া আম্পান মাছের খামার, কৃষি জমি কোনো কিছুকেই নিস্তার দেয়নি। কাজ নেই এখন সাহিল মোড়লের, তাই আয়-রোজগারও বন্ধ। তাই নতুন করে আবার একটি ঘরের কাজ শুরু করা ভাবনা একেবারেই অসম্ভব!

“কী করে পরিবার নিয়ে এখন টিকে থাকব?” বলছিলেন মোড়ল। “এ মুহুর্তে সাতক্ষীরার এই বাস্তভিটা ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনো উপায় নেই। তাই কাল ভোরে সিলেটে ( দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি জেলা) চলে যাচ্ছি। সেখানে আমার কিছু আত্মীয়-স্বজন থাকেন। তারা কয়েকবছর আগে থেকেই সাতক্ষীরা ছেড়ে সিলেটে বসবাস করছেন। আমি সেখানে কোনো কাজ জোগাড় করতে পারলেই কিছু দিন পর পরিবারের সবাইকে সেখানে নিয়ে যাবো”।

এ বছরের ২০ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশপাশের আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকাগুলোতে আঘাত করে সাইক্লোন আম্পান। শক্তিশালী এই ঝড়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ ও আদিবাসী অধ্যূষিত এলাকাগুলো ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

আর পশ্চিমবঙ্গের ঠিক পাশেই বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার অবস্থান। ঝড়ের ভয়াবহতা তাই এখানেও ছিল পশ্চিমবঙ্গের মতোই। এবারকার শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার বন্যা সূরক্ষা বাঁধ, ঘর-বাড়ি আর অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির মূলে থাকা মৎসখাত ও কৃষি মারাত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানকার এই মৎস খামারগুলোতে কাজ করে জীবিকা আহরণ করতো হাজার হাজর পরিবার, যারা এই খাতের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত।

সাহিল মোড়ল বলেন, সাইক্লোনের সময় আমরা সবাই প্রান বাঁচাতে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান করছিলাম। ঝড়ের তাÐব থেমে গেলে যখন ফিরে এলাম, দেখলাম চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। এই ক্ষতি কাটিয়ে আবার কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো, জানিনা।

আম্পানের কারনে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির এক বিবরণীতে বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, দেশের ১৫০ কিলোমিটার বন্যা/গ্রাম সূরক্ষা বাঁধ (বেড়ি বাঁধ) ধ্বংস হয়ে গেছে। উপক‚লীয় ঝড় ও জোয়ারের সাথে আসা নোনা পানি থেকে গ্রামগুলোকে রক্ষা করতে এই বাঁধ নির্মান করা হয়। এছাড়াও এই ঝড়ের কারনে প্রায় ৫৫,৬৬৭টি বাড়ি এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে সেগুলো নতুন করে নির্মান করা ছাড়া আর কোনো গত্যান্তর নেই। এছাড়াও ঝড়ের কারনে ক্ষতিগ্রস্থ্য জেলাগুলোতে সব মিলিয়ে ১৮,২৩৫টি সুপেয় পানির উৎস (জলাধার, নলক‚প) পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। উপক‚লীয় এই জেলাগুলোতে জলাধার বা পুকুর যেগুলো প্রচুর সুপেয় পানির উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হতো সেগুলো এখন জলোচ্ছ¡াসের সাথে বয়ে আসা নোনা পানিতে পূর্ণ।

 

ছবিগুলো ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার কয়েক সপ্তাহ পরে তোলা হয়েছে।  ছবিগুলো তুলেছেন ইনজামামুল হক।

 

Bangladesh Cyclone Flood
ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার পর সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগরের প্রায় সব মাছের খামার, কৃষি জমি, পুকুর, বাড়ি-ঘর আর রাস্তাঘাট এখন জলোচ্ছ¡াসের সাথে আসা নোনাজলে তলিয়ে গেছে

 

প্রবল জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে উপকূলীয় গ্রাম আশাশুনির সব মিঠাপানির উৎস যেমন পুকুর এখন লবনাক্ত পানিতে পূর্ণ। গ্রামে এমন অর্ধ-নিমজ্জিত মাত্র কয়েকটি নলকূপই এখন সুপেয় পানির প্রধান উৎস।

 

বন্যার পানির তোড়ে গ্রামের প্রায় সবগুলো নলকূপই নিমজ্জিত কিংবা অকার্যকর। তাই সুপেয় পানির প্রয়োজনে গ্রামবাসী সরকার কিংবা এনজিও কর্মীদের সাহায্যের আশায় লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। দেশে এখন কোভিড-১৯ এর উচ্চ সংক্রমন চলছে। বস্তুত কেবল সুপেয় পানি সংগ্রহের এই সময়টিতেই গ্রামবাসীদের শারিরীক দূরত্ব বজায় রাখাসহ কিছুটা স্বাস্থ্যবিধী মেনে চলতে দেখা যায়। তবে যে বিষয়টি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো তা হচ্ছে খাবার পানি সংগ্রহের কাজটিতে পুরুষদের দৃশ্যত কোনো উপস্থিতি দেখা যায় না।  

 

আম্পানের প্রভাবে সৃষ্ট প্রবল জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল পাঁচ বছরের শিশু নাজমূল (ছবির কেন্দ্রে)। নাজমূলের বাড়ি কুড়িখানিয়া গ্রামে। ঝড় থেমে গেলে দু’দিন পরে তাকে খুঁজে পায় তার পরিবার। প্রচ-ভাবে মানসিক বিপর্যস্ত নাজমূল এখন ঘরের বাইরে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। ঘর থেকে এখন আর সে বের হতে চাইছে না।

 

এবারের আম্পানে ভেসে গেছে বসতভিটা। ঝড়ের পরে আবার নতুন করে সবকিছু শুরুর চেষ্টা। প্রতাপনগর গ্রামের এই পরিবারটি তাই টিকে থাকা যৎসামান্য জায়গাটুকুতে আবারো ঘর বেঁধেছে। পর্যাপ্ত জায়গা নেই, তাই পাশে থাকা খালের পাড় লাগোয়া তাদের নতুন ঘরে জোয়ারের পানি ঘর ছুঁয়ে যাচ্ছে। অভাবনীয় স্যাঁতসাঁতে এই পরিস্থিতিতে মাটির উনুনে আগুন জ্বালানো যেন আরেক সংগ্রাম।

 

 চারিদিকে বন্যার লবনাক্ত পানি। কোথাও এতটুকু চারণভূমি অবশিষ্ট নেই। চাকলা গ্রামের অধিবাসীরা অনেকেই তাই প্রিয় গৃহপালিত পশুদের নিয়ে যাচ্ছে অন্য গ্রামে যেখানে হয়ত এখনও কিছুটা উঁচু ভূমি অবশিষ্ট আছে মনে করছেন তারা। যদি পাওয়া যায় তেমন কোনো জায়গা হয়ত পশুগুলোর জন্য কিছুটা খাদ্যের যোগান হবে।

 

সরকার বা অন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তার অপেক্ষায় না থেকে বন্যতলা গ্রামের বাসিন্দারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাম সুরক্ষা বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করে দিয়েছেন। এই বাঁধগুলো নির্মান করা হয়েছিল যাতে জোয়ার-ভাটা বা ঝড়ের সময় সাগরের লবনাক্ত পানি  গ্রামের ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু এবারের ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এইসব বাঁধের বিভিন্ন স্থানে ফাটল সৃষ্টি হয় এবং কোথাও কোথাও ভাঁধ ভেঙ্গে গ্রামে লবনাক্ত পানি প্রবেশ করে।

 

ঘুর্ণিঝড় আম্পানে গাবুরার পাশেই নেবুবুনিয়া গ্রামে বাস করা সোহরাব হোসেনের বাড়িটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়। ঝড়ের পর আবারো তাই বেঁেচ থাকার লড়াই। এখন নতুন ঘর বাঁধার কাজ শুরু করছেন সোহরাব। নদীর পাশে তীর ঘেষে যতটুকু জায়গা পেয়েছেন, কোনে রকমে সেখানেই একটু মাথা গোঁজার ঠাই তৈরী করে নিচ্ছেন। তার একটিই প্রশ্ন – বড় বড় মানুষেরা কেন আমাদের এই বাঁধগুলোকে ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করেন না?

জলবায়ু উদ্বাস্তু

গত বছরের ঘুর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে নতুন করে নিজেদের ঘরের মেরামতের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন বন্যতলা গ্রামের এই পরিবারটি। এবার আম্পান আবরো তান্ডব চালালো, সম্বল বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাই বাধ্য হয়েই বেঁচে থাকার আশায় নিজের বসতভিটা ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত এই পরিবারটি – সামনে হয়ত অনিশ্চিত এক ভবিষ্যত।

 

 

 

আম্পানে তোড়ে ভেসে গেছে ঘর, লবনাক্ত পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলের মাঠ আর মাছের খামার। তবুও বেঁচে থাকতে হয় মানুষকে। বন্যতলা গ্রামের এই পরিবারটির এ অবস্থায় গ্রাম ছেড়ে অন্য কোনো আশ্রয়ের খোঁজে তাই বেরিয়ে পড়ার যেন আর কোনো বিকল্প নেই।  অনুবাদ: আরিক গিফার