জলবায়ু

ব্রেক্সিট কি জলবায়ু সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় নীতি পরিবর্তনে প্রভাব ফেলবে?

চার দশকের ঐক্যের পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ও চীনের সাথে যুক্তরাজ্যের চলমান জ্বালানী ও পরিবেশ সংক্রান্ত সহযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো ছেদ পড়বে না বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলা
<p>David Cameron announced that Britain had voted to leave the European Union. [image by UK Government]</p>

David Cameron announced that Britain had voted to leave the European Union. [image by UK Government]

গত ২৪ জুন ছিল শুক্রবার – যুক্তরাজ্যের জন্য এটি ছিল অন্যরকম একটি সকাল। সেদিনের ওই সকালে সারাবিশ্বের কাছে যুক্তরাজ্যের অবস্থান পুরোপুরি পাল্টে যায়। টানা ৪০ বছর সদস্য থাকার পর ইউরোপিয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকা আর না থাকা নিয়ে গণভোট ডেকেছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরণ। আগের রাতে গণভোটের ফল প্রকাশ হয়। দেখা যায় গণভোটে অংশগ্রহনকারী ভোটারদের ৫৩ শতাংশই রায় দিয়েছেন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এ মুহুর্তে ইইউ আর যুক্তরাজ্য ভিন্ন দুটি স্বত্বা, দু’টি ভিন্ন এলাকা।

ফলাফল ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন ক্যামেরণ  – যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় এক রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। পড়তে শুরু করে বৃটিশ পাউন্ডের বাজার দর – ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্ণর দেশের মুদ্রাবাজারগুলোকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। ভবিষ্যতে কী ঘটবে সে ব্যাপারে আগাম কোনো ধারণা না পাওয়া গেলেও, বিশেষজ্ঞদের কথায় মনে হচ্ছে আগামীতে কঠিন এক সময় অপেক্ষা করছে বৃটিশ অর্থনীতির ভাগ্যে।

গণভোটের এই রায়ের মাধ্যমে গভীরভাবে বিভক্ত একটি দেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড, লন্ডন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং ২৫ বছরের নিচের ভোটাররা ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট প্রদান করেন। অন্যদিকে ওয়েলস ও প্রাদেশিক ইংল্যান্ডের ভোটাররা খুব নগ্নভাবে ইইউ থেকে বেরিয়ে আসার ব্যাপারে ভোট প্রদান করে।

আমার বলতে আপত্তি নেই যে  এই ফলাফল আমাকে নিরাশ করেছে। তবে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ফলাফলটিকে বিশ্লেষন করা এবং একইসাথে যুক্তরাজ্যের সাথে ইউরোপ এবং দেশটির আন্তর্জাতিক জলবায়ু নীতি এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন ভারত ও চীনের সাথে চলমান সম্পর্কে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেবিষয়ে দৃষ্টি দেয়া।

দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল বিচ্ছেদ

ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার প্রক্রিয়াটি হবে বেশ দীর্ঘ ও ব্যয়বহুল। আনুষ্ঠানিকভাবে ৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি ইইউ থেকে বেরিয়ে আসতে যুক্তরাজ্য দশ বছরের মতো সময় পাবে।  তবে সামগ্রীক প্রক্রিয়া শেষ হতে তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগদে পারে। গত চার দশকে প্রণীত বিভিন্ন আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। এছাড়া আরো ১২,০০০ প্রবিধান পর্যালোচনা করতে হবে  – এর মধ্যে হয়ত কোনোটি বাদ যাবে আবার কোনোটি হয়ত টিকে যাবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে এসব কাজের জন্য অনুকূল একটি সংসদের প্রয়োজন হবে যার মাধ্যমে এই সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করিয়ে নেয়া যায়। একইসাথে ইইউভূক্ত ২৭টি দেশসহ অন্যান্য যেসব দেশের সাথে ইইউ প্রনীত বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তির আওতায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করা হতো সেই আইনেও পরিবর্তন আনতে হবে এবং ওই দেশগুলোর সাথে নতুনভাবে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।

এর সঙ্গে যুক্ত আছে যুক্তরাজ্যের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বিষয়টিও। যেহেতু স্কটল্যান্ড ইইউতে থাকার পক্ষে ভোট দিয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যেতে পারে যে তারা এখন নিজেদের স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তরাজ্যের উপরে চাপ প্রয়োগ করতে পারে।

এবার আসা যাক দেশটির পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র নীতি, জলবায়ু সংক্রান্ত নীতি কেমন হবে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। এসব বিষয় সামাল দিতে যুক্তরাজ্যের বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। অভ্যন্তরীণ এই ধাক্কা সামলে উঠতে গিয়ে জলবায়ু কূটনীতিসহ আন্তর্জাতিক অনেক ইস্যুতে নিজেদের নেতৃত্বসূলভ অবস্থান থেকে কিছুটা পিছিয়েও পড়তে হতে পারে।

এখন কেবল একটি সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত  – তা হচ্ছে যুক্তরাজ্যকে ইইউ ত্যাগ করতে হবে। এই বেরিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন শর্ত ও ইউরোপের সাথে দেশটির ভবিষ্যত সম্পর্ক নির্ধারনে হয়ত লেগে যাবে বেশ দীর্ঘ সময়।

অগ্রাধীকারে জলবায়ু

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় একটি যুৎসই অর্থনীতি, সামাজিক ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে আমরা প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছি। আমরা কাজ করছি এমন একটি পৃথিবীর জন্য যেখানে প্রকৃতি ও মানবজাতি বিশুদ্ধ, সুস্থ্য ও উৎপাদনশীল একটি পরিবেশে সহাবস্থান করতে পারে। ইইউসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু ইস্যুতে যুক্তরাজ্য সবসময়ই তৎপর থেকেছে। আমাদের জন্য এটি এখনও একটি জরূরী অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচিত হতে হবে।

পরিবর্তিত আইএনডিসি

অন্যান্য ইইউ সদস্য দেশের মতো যুক্তরাজ্যের জলবায়ু নীতি ইউরোপিয় ফ্রেমওয়ার্কের আলোকে মেনে চলতে বাধ্য এবং এই আইনগুলোর আলোকে যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীন পরিবেশ নীতিও পরিচালিত হয়। এতদিন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ছিল জলবায়ু সুরক্ষার পক্ষে থাকা ইউরোপের অন্যতম একটি  দেশ। এখন ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কারণে যুক্তরাজ্যকে তার নিজের আইএনডিসি পর্যালোচনা করতে হতে পারে। যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া ইইউকে এখন এসব ক্ষেত্রে কিছুটা দূর্বল ও বিভ্রান্ত  করে তুলবে। পরিবর্তীত এই পরিস্থিতিতে জলবায়ু ও পরিবেশ সংক্রান্ত নীতিগুলোকে এখন হয়ত প্রধানতম অগ্রাধীকার হিসেবে বিবেচনা নাও করা হতে পারে।

জলবায়ু ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের নিজেরও রয়েছে কাজ করার সুদীর্ঘ ইতিহাস। ১৯৯৫ সালে তারা কিওটো প্রোটোকলে সই করেছে এবং ২০০৮ সালে তারা নিজেদের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আইন পাশ করেছে। এসব আইন পাশের মাধ্যমে তারা আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ১৯৯০ সালের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ৮০ শতাংশ কমিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য এখনো ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর স্বাক্ষরকারী একটি দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান অপরিবর্তিত রাখবে।

স্থানীয় পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন আইনের আওতায় পঞ্চম কার্বন বাজেটের বিষয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্ত হবে। দেশের বিদ্যুত বাজার সংস্কারের প্রক্রিয়াও থাকবে অব্যাহত। একইসাথে ২০২৫ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্তও অপরিবর্তিত থাকবে। যদিও নিজেদের একটি আইএনডিসি জমা দিতে হবে তারপরেও বলা যায় যুক্তরাজ্য প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করবে।

অবশ্য এই আইনগুলোর কোনোটিই গণভোটের কারনে পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপরেও বলা যায় এই ছেড়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে ইইউ’র অভ্যন্তরীণ জ্বালানী বাজার, ইইউ এমিশন ট্রেডিং স্কিম, জলবায়ু ইস্যুতে অংশগ্রহনকারী সিদ্ধান্ত এবং ইউএন ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেট  চেঞ্জ ইস্যুতে এর প্রভাব হবে লক্ষণীয়।

গত ৪০ বছর যাবত বিশ্ববাজারের সাথে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য সম্পর্ক ইউরোপের প্রচলিত আইনের দ্বারাই প্রভাবিত ছিল। সময় এসেছে এখন এনিয়ে  বিকল্প চিন্তার। এখন ইউরোপিয় অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইইএ) কিংবা  ইউরোপিয় মুক্ত বাণিজ্য সংস্থা’র (ইএফটিএ) পাশাপাশি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের বাপারেও কাজ শুরু করতে হবে।

ইতিবাচক সম্পর্ক

সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানী ও জলবায়ু নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কার্বন নির্গমন হ্রাস ও সংগতিপূর্ণ  প্রযুক্তি বিনির্মানে চীন ও ভারতের সঙ্গে কাজ করছিল যুক্তরাজ্য। এটি ভাবার কোনো কারন নেই যে যুক্তরাজ্য সক্রিয়ভাবে এই সম্পর্কের পথ থেকে বেরিয়ে যাবে।

স্বল্প মাত্রার কার্বণ প্রযুক্তি সংক্রাš যে সহযোগিতার সম্পর্ক চীনের সাথে যুক্তরাজ্যের রয়েছে তা কি কোনোভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে? এ বছরের গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যের দামী গাড়ি প্রস্তুতকারী কোম্পানী এসটোন মার্টিনের সাথে চায়না ইক্যুইটি’র সাথে ৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের একটি চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তির আওতায় একটি বৈদ্যুতিক স্পোর্টস কার তৈরি করা হবে। চীনের গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গীলি একই সময়ে  আরো ৫০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করেছে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য। এই গবেষনার মাধ্যমে তারা যুক্তরাজ্যের ব্ল্যাক ক্যাবের নতুন একটি সংস্করণ তৈরি করবে যেটি হবে শূন্য মাত্রার কার্বণ নির্গমনকারী একটি গাড়ি। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের একটি বাস নির্মান কোম্পানী চীনের বিওয়াইডি’র সাথে আরো ৬৬০ মিলিয়ন পাউন্ডের এটি চুক্তি করেছে। এর আওতায় তারা বৈদ্যুতিক বাস নির্মান করবে।

এ মুহুর্তে বিদ্যুত কেন্দ্র উন্নয়ন ও স্বল্প মাত্রার কার্বণ নির্গমনকারী জ্বালানী প্রস্তুতকল্পে যুক্তরাজ্যের ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড বিনিয়োগ প্রয়োজন। গণভোটের ফলাফলের কারনে চীনসহ বাইরে থেকে এ ধরনের প্রকল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারন এখন যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি কিছুটা চাপের মুখে এবং ইউরোপের বড় বড় বাজারের সাথে দেশটির সম্পর্কের পরিবর্তন হতে পারে।

এদিকে গণভোটের কারনে ধারণা করা হচ্ছে যুক্তরাজ্য-চীন পরিচালিত বিশেষ একটি প্রকল্প বাধাগ্রস্থ হতে পারে। এটি হচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিম যুক্তরাজ্যের সমারসেটে স্থাপিত হিংকলে পয়েন্ট সি পারমানবিক কেন্দ্র। এতে চায়না জেনারেল  নিউক্লিয়ার পাওয়ার অর্গানাইজেশন -এর প্রায় ৬ বিলিয়ন পাউন্ডের বিনিয়োগ রয়েছে। প্রকল্পটির স্থাপনে সহযোগিতা দিচ্ছে ফ্রান্সের কোম্পানী ইডিএফ। এই প্রকল্পের ৩৩.৫ শতাংশ অশীদারিত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। পাশপাশি চীন এসেক্সের ব্র্যাডওয়েলে আরো একটি পারমানবিক চুল্লি স্থাপন ও পরিচালনার পরির্বতে সাইজওয়ালে একটি নতুন আরো একটি পারমানবিক চুল্লি স্থাপনে আর্থিক সহযোগিতারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ অবস্থায় ক্রমাগত বিলম্বের কারনে এরই মধ্যে হিংকলে পয়েন্ট সি প্রকল্পে আস্থা হারাতে শুরু করেছে চীন। এখন যে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে তাতে হয়ত আরো কোনো নেতিবাচক সিদ্ধান্তের পথে হাটতে পারে চীন।

এখন থেকে জলবায়ু ও পরিবেশগত ইস্যুটি এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের উপরেই বর্তাবে।  চলমান হতাশা আর অনিশ্চয়তা সত্বেও এটিই যে এখন মূল অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত তা এখন অনেকটাই পরিস্কার।

(নিবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় chinadialogue.net।  লেখক ইসাবেল হিলটন chinadialogue.net এর সিইও ও সম্পাদক। নিবন্ধটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন ফারজাদ খাঁন)