icon/64x64/livelihoods জীবিকা

বাংলাদেশে মিঠা পানির সংকট ক্রমেই ঘনীভূত করে তুলছে এখানকার চিংড়ি শিল্প

ব্যাপকভিত্তিক জলজচাষ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে গঙ্গা অববাহিকায় ভূমি ও পানির উৎসগুলো লবানাক্ত হয়ে পড়ছে

বাংলাদেশের কক্সবাজারের ফিশারি ঘাট বাজারে চিংড়ি ওজন করে বিক্রি হচ্ছে (ছবি: মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান/এলামি)

প্রায় ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষ একটি স্বল্পকালীন অর্থনৈতিক মুনাফা প্রদানকারী একটি কৃষি হিসেবে গড়ে উঠেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্বক প্রভাবের বিষয়টি এর সঙ্গে যুক্ত হবার পর এটি এখন ক্রমেই পরিবেশ এবং স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য একটি বিপজ্জনক অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবে প্রমানিত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে বদ্বীপ এই দেশটির জনগণ  আগামী ২০৫০ সালের মধ্যেই সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় ৫০ সে.মি বৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশে এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে অব্যাহতভাবে এখানকার জনবহুল উপকূলীয় অঞ্চলে বিরুপ পরিস্থিতি তৈরি করছে যার ফলে এখানকার অধিবাসীরা নিয়মিত জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়ে অন্যান্য স্থানে অভিবাসন করছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে কেবল ভূমি বা জমি হারাবে না বরং এটি এখানকার জনগণের জীবন-জীবিকায় মারাত্বক নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে কারন এর ফলে সমুদ্র থেকে লবন পানি সব ধরনের জলাধার এবং পানির উৎসগুলো লবনাক্ত করে তুলবে যা মূলত আগে ফসল উৎপাদন, গৃহপালিত পশু পালন ও মানুষের অন্যান্য দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হতো।

১৯৭৩ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত বিদেশ রপ্তানী করে চিংড়ি খাত থেকে বাংলাদেশ ২.৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৫৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত আয় করেছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেক বাংলাদেশে এই শিল্প ক্রমেই বড় হতে শুরু করে, বিশেষ করে এই শিল্পটির জন্য দেশের বাইরে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশের সাবেক মৎস মন্ত্রী মোহাম্মদ আফতাবুজ্জামান দ্য থার্ডপোলকে বলেন, আমি ১৯৮০ সালে বাংলাদেশের মৎসমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করি। এবং তখন থেকে আমি বাণিজ্যিকভাবে চিংড়ি চাষকে সরকারের একটি নীতি হিসেবে অনুমোদন করি। কারন আমাদের সরকার মনে করেছিল এই চিংড়ি চাষের মধ্য দিয়ে আমরা দেশের অর্থনীতিকে আরো সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবো। আর পরবর্তীতে আমরা এই ধারণার বাস্তবয়ন  হতে দেখেছি।

কিন্তু তখন থেকেই এই খাত থেকে আয় কমতে শুরু করেছে। ব্যাপকভিত্তিতে এর চাষের ফলে নানা ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ায় চিংড়ি চাষ ও এর থেকে উপার্জন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

একদিকে যেমন চিংড়ি উৎপাদনের মাত্রা নিচের দিকে নামতে শুরু করে অন্যদিকে ব্যাপকভিত্তিক বাণিজ্যিক উৎপাদনের ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বিশেষ করে দক্ষিনপশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলোর ভূমি, জলাশয়, নদী এবং অন্যান্য পানির উৎসগুলোতে লবনাক্ততার মাত্রা বাড়তে শুরু করে।

বেসরকারী থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জ এর নির্বাহী পরিচালক আহসান উদ্দিন বলেন, চিংড়ি চাষের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে যেসব জমিতে একসময় ধান উৎপাদন করা হতো সেখানে চিংড়ির ঘের তৈরি করা হয়। যেহেতু চিংড়ির জন্য প্রয়োজন লবন পানি, তাই এসব জমি বা খামারে লবন পানি প্রবেশ করানো হয়। আর এটি করতে গিয়ে অনেক সময় বন্যা থেকে জমির ধান, মিঠা পানির উৎস আর ঘরবাড়ি সুরক্ষা করতে যে বাঁধ নির্মান করা হতো তা ভেঙ্গে বা ক্ষতি করে খামারে লবন পানি প্রবেশ করানো হয়। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিএফএফইএ) এর তথ্য মতে, এই মুহুর্তে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৩৩৭,১৬৪ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ২৭৬,০০০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে, অর্থাৎ প্রায় চাষাবাদযোগ্য ভূমির ৮১ শতাংশই ব্যবহৃত হচ্ছে চিংড়ি চাষে। আর এর মধ্যে ১৯৫,০০০ হেক্টর অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ চাষ হচ্ছে সাতক্ষিরা, খূলনা আর বাগেরহাট জেলায়।

Enclosures for shrimp farms in Khulna division, Bangladesh, SK Hasan
বাংলাদেশের খূলনা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য জমিতে ঘের দেয়া হয়েছে (ছবি: এসকে হাসান আলী/এলামি)

চিংড়ি চাষের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে কৃষকদের

যেহেতু চিংড়ি চাষের জমির চারপাশে ছোট ছোট আরো চাষের জমি থাকে, চিংড়ির খামার থেকে সবসময়ই লবনাক্ত পানি পাশে থাকা অন্যান্য ফসলের জমিতে প্রবেশ করে। এর ফলে সেসব জমিতে চাষ করা ধান নষ্ট হয়ে যায়, এমনকি বাঁধ নষ্ট করে জমিতে পানি প্রবেশ করানোর প্রচেষ্টা শুরু কবার অনেক আগে থেকেই এটি ঘটতো। একারনেই বেশিরভাগ কৃষক ধান চাষ বাদ দিয়ে চিংড়ি চাষের দিকে ধাবিত হতে শুরু করে। বেশিরভাগই অধিক লাভের আশায় এই চিংড়ি চাষ শুরু করে। আবার অনেকেই কোনো উপায় না পেয়ে একান্ বাধ্য হয়েই চিংড়ি চাষে যুক্ত হয়।

সাতক্ষীরা জেলার সৈলখালি গ্রামের মোহাম্মদ আব্দুল জলিল (৬২) তার গ্রামের অন্যান্যদের মধ্যে সবার শেষে চিংড়ি চাষের সঙ্গে যুক্ত হন। দ্য থার্ডপোলকে তিনি বলেন, আমি আসলে গত ২৫ বছর আগে (১৯৯০ সালের শেষ দিকে) একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমার আট একর জমিতে চিংড়ি চাষ শুরু করি। কারণ আমি দেখলাম আমার জমির চারপাশের সব জমিতে তখন চিংড়ি চাষ শুরু হয়ে গেছে। আর এর কারনে আমার জমিটুকুও লবনাক্ত হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ এনভায়রণমেন্ট লয়ার্স এসোসিয়েশন এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আসলে শুরু থেকেই এই সেক্টরটি স্থানীয়দের অধীকার লংঘন করে কাজ করছে। এটিকে আবার অনেকটাই উৎসাহ প্রদান করা হয়।

তিনি বলেন, প্রথমদিকে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই চাষবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর অনেক মাঝারী খামারী যারা হয়ত কেবল ধান চাষের সঙ্গেই যুক্ত ছিল তাদেরও অধিক মূনাফার আশায় ব্যাপকভিত্তিতে উৎসাহিত করা হয় চিংড়ি চাষে যুক্ত হতে। আর সবশেষে ক্ষুদ্র চাষীরা চিংড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় একপ্রকার বাধ্য হয়েই। কারন তাদের ছোট ছোট জমির চারপাশে তখন এরই মধ্যে ব্যাপক হারে চিংড়ির খামার গড়ে উঠেছে।

সাতক্ষীরা জেলায় চিংড়ি চাষীরা স্থানীয় খোলপেটুয়া নদী থেকে পাম্পের মাধ্যমে জমিতে লবন পানি প্রবেশ করায় (ছবি: আবু সিদ্দিক)

চিংড়ি চাষের প্রভাব

ওয়াটার এইড সাউথ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক খাইরুল ইসলাম বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের পানি কখনই এতটা লবনাক্ত ছিল না। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, আমরা দেখেছি যেখানে চিংড়ি খামার রয়েছে ঠিক সেই অঞ্চলগুলোতেই বিশুদ্ধ পানির সংকট সবচেয়ে বেশি।

খাইরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে পুকুর হচ্ছে বিশুদ্ধ পানি বা মিঠা পানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। যখন আশেপাশে চিংড়ি চাষ করা হয়, তখন চিংড়ির খামার থেকে লবনাক্ত পানি মাটি চুইয়ে চুইয়ে পুকুরে প্রবেশ করে এবং তার পানিকে লবনাক্ত করে তোলে।

২০১৯ সালে ওয়াটারএইড বাংলাদেশ পরিচালিত এক গবেষণার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ৫৭টি পুকুরের পানি পরীক্ষা করা হয়।   এসব পুকুরের মধ্যে ১৬টি পুকুরের পানিতে লবনাক্ততার মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যা কোনোভাবেই পান বা রান্নার যোগ্য নয়। অন্য ২৫টি পুকুরের পানি লবনাক্ততার কারনে পান করার অযোগ্য হলেও রান্নার ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত পাওয়া যায়। বাকি ১৪টি স্থানীয় অধিবাসীদের আওতার বাইরে ছিল কারণ সেখানে চিংড়ি চাষ করা হতো। খূলনা ও  বাগেরহাটে একই পরিস্থিতি দেখা যায় বলে জানান ইসলাম। উপকূলীয় এলাকায় দিনের পর দিন বিশুদ্ধ পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে তাই সেখানকার অধিবাসীরা এখন জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বর্ষা মৌসুমে যতটুকু সম্ভব বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে রাখে। এছাড়া তাদের কেবল পান করার পানি কিনতে হয় যার মূল্য রাজধানীতে বসবাস করা অধিবাসীদের প্রদান করা মূল্যের ৪০ গুন বেশি।

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় বসবাস করা এই নারীকে তার নিজের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দুরের এক পুকুর থেকে প্রতিদিন পানি সংগ্রহ করতে হয় (ছবি: আবু সিদ্দিক)

শ্যামনগর উপজেলার দূর্গাবাটি গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ সুভদ্রা মণ্ডল বলেন, বর্ষা মৌসুমে আমরা পাত্রে যতটুকু সম্ভব পানি সংরক্ষণ করি। আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে পান করার জন্য আগে বহনযোগ্য পাত্রে পানি সংরক্ষণ করা। আমরা সংসারের অন্যান্য কাজে পুকুরের বা খালের পানি ব্যবহার করি, তা সে লবনাক্ত হোক বা না হোক।

পানি কিনে আনার সময় সুভদ্রা মণ্ডল একটি ছোট একটি ভ্যান ব্যবহার করেন। আসা আর যাওয়াতে তার প্রায় দুই ঘন্টা সময় প্রয়োজন হয়।

বিশিষ্ট পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, উপকূলীয় এলাকার অনেক মানুষের মধ্যে বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোতে প্রয়োজনের চেয়ে পানি কম পানের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। আর এর ফলে তাদের মারাত্বক ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

শ্যামনগরের সংসদ সদস্য জগলুল হায়দারও মনে করেন চিংড়ি চাষের জন্য খাবার পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে। তবে তিনি একথাও বলেন যে চিংড়ি চাষ সহজেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। কারণ এর মধ্য দিয়ে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক মূদ্রা আসছে দেশে।

তার নিজেরও চিংড়ির খামার রয়েছে বলে উল্লেখ করেন শ্যামনগরের এই সংসদ সদস্য।

অনুবাদ: মোর্শেদা আক্তার পরী