(English) Ganga-Brahmaputra-Meghna world’s most vulnerable delta
জুন 16, 2016
এবারের বর্ষায় বাংলাদেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশই বন্যার কবলে নিমজ্জিত, আর এই বন্যায় ঘর-বাড়ি হারিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে প্রমত্তা পদ্মার চরের হাজারো মানুষ
A family in Madaripur district lead their livestock as they leave their flooded home
সম্পাদকীয় বার্তা: নেপাল, ভারত আর বাংলাদেশে বিস্তৃত কোশি-গঙ্গা-পদ্মা নদী অববাহিকায় বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে চলমান তিন পর্বের ধারাবাহিকের শেষ পর্ব আজ প্রকাশিত হলো। ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অন্যান্য পর্ব পড়তে ক্লিক করুন এখানে।
বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকে জন্ম নেয়া অনেক চরের মধ্যে একটির নাম চর জানাজাত। এই চরেরই বাসিন্দা আহমেদ হাওলাদার ও তার পরিবার। বঝরের পর বছর বন্যা, ভাঙ্গন আর আশ্রয় হারানোর ঘটনাগুলো যেন হাওলাদারের মতো সারাদেশের বিভিন্ন চরে বসবাসরত লক্ষ লক্ষ বাসিন্দাদের জীবনে একটি সাধারণ ঘটনা। নদীর বুকে পলি জমে জন্ম নেয়া দ্বীপের মতো এক টুকরো ভূখন্ডগুলো স্থানীয়ভাবে চর নামে পরিচিত এদেশে। ষাটোর্ধ হাওলাদার তার পরিবারের সাথে সেই শিশু বয়স থেকেই এক চর ছেড়ে অন্য চরে গিয়ে ঘর বেঁধে আসছেন। আর এভাবেই চলে চরের মানুষের জীবন।
যখনই বন্যা হয়, ভেসে যায় আমাদের বাড়ি-ঘর, শস্য আর সহায়-সম্বল। প্রাণ যায় চরের বহু মানষের। প্রমত্তা পদ্মা বেড়ে নেয় আমাদের আশ্রয়, জীবন আর জীবিকা। আর এভাবেই সব হারিয়ে কোনোভাবে টিকে থাকার লড়াই করি আমরা। বেঁেচ থাকার সংগ্রামে জীবিকা আর আশ্রয়ের খোঁজে তাই আমরা ছুটে চলি এক চর থেকে আরেক চরে।
কথাগুলো বলছিলেন চর জানাজাতের হাওলাদার। তিনি বলেন, এবারের বন্যায় পানিতে আমার ঘর তলিয়ে গেছে। প্রবল ¯্রােতে ভেসে গেছে আমাদের গবাদী পশু। কোনো মতে পরিবারের সদস্যরা নিজেদেও জীবনটা নিয়ে বেঁচে আছি। এই করোনা মহামারির মধ্যে হাজারো গৃহহীন মানাষের সাথে হাওলাদার ও তার পরিবারের সদস্যরা মহাসড়কে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন।
অন্যান্য অনেক মানুষের মতো হাওলাদার এখন নদীতে মাঝে মাঝে মাছ ধরতে যায়। তাদের সবার মনে আশা, খুব শীঘ্রই হয়ত নদীর পানি কমে গেলে তারা নিজেদের চরে ফিরতে পারবে। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বন্যার পানি কমার কোনো লক্ষণই নেই। অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছেই না হাওলাদারদের।
এবছর জুলাই মাসে অতিবৃষ্টি গত এক দশকের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এর ফলে সৃষ্ট প্রবল বন্যায় দেশের প্রায় এক-তৃতিয়াংশ ডুেেব গেছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য মতে, ক্ষতিগ্রস্থ্য মানুষের সংখ্যা ২৮ লাখ।
মানচিত্রে প্রবল বন্যা পরিস্থিতির চিত্র
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট বন্যার পানি উজান থেকে আসা সব নদ-নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গত আগষ্ট মাসে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করে। জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, দশ লাখেরও বেশি মানুষ এখনও বন্যার কারনে সুপেয় পানি আর পয়:নিষ্কাষণ সমস্যার মধ্যে রয়েছে।
সরকার দূর্গত মানুষের সহায়তায় সারাদেশে জরুরী ত্রাণ সামগ্রীর প্রদান করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ৬৭৪.১৫ টন চাল, ১১.৪৪ লাখ নগদ টাকার (১২,৫০০ মার্কিন ডলার) নগদ অর্থ সাহায্যসহ শিশু খাদ্য, শুকনো খাদ্য ও গবাদী পশুর খাদ্য।
চর – এক দূর্বিষহ বসত
পদ্মা নদীটি মূলত গঙ্গা নদীর পশ্চিম প্রবাহে সৃষ্ট ¯্রােতধারা। প্রায় ২১০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই গঙ্গা নদী থেকে শত শত ছোটবড় নদী ও জলপ্রবাহের সৃষ্টি যা এক পর্যায়ে পদ্মায় পতিত হয়েছে।
প্রতিবছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এখানকার সবগুলো নদী সারাবছরের তুলনায় বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পানি ধারণ করে। এর ফলে এই নদীগুলোর প্রবাহে পরিবর্তন আসে আর যার ফলে সৃষ্টি হয় বন্যা। আর নদ-নদীগুলো বর্ষায় সৃষ্ট বন্যার পানিে হিমালয় থেকে প্রচুর পরিমানে পলি বয়ে নিয়ে আসে। বন্যায় সময় নদীর গতি পরিবর্তন হয়ে এর এক অংশে যখন ভাঙ্গন সৃষ্টি হয় তখন অন্য অংশে পলি জমে সৃষ্টি হয় দ্বীপের মতো ভূখন্ড। আর এর নামই হচ্ছে চর।
নদীর গতিপথে সৃষ্টি হওয়া এই চরই একসময় অনেকের জন্য হয়ে ওঠে আশ্রয়স্থল আর কৃষি কর্মকান্ডের জন্য উৎকৃষ্ট স্থান।
চরে সবচেয়ে দরিদ্র আর সহায়-সম্বলহীন মানুষের বসবাস। ২০১০ সালে পরিচালিত এক গবেষনায় দেখা গেছে বাংলাদেশের চরগুলোতে মোটামুটি ১২ মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে। বর্ষা মৌসুমে এসব চরের মধ্যে অনেকগুলোই ডুবে যায় বন্যায়। তাই এই চরগুলোতে বসবাসকারীরা সাধারণত অস্থায়ি ভিত্তিতে ঘরবাড়ি নির্মান করে থাকে যাতে বন্যা বা অন্য কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ্য হলে যেন আবারো নতুন করে তা নিমৃান করা যায়। আর এর ফলে এই মানুষগুলোর কোনো স্থায়ি ঠিকানা থাকেনা। ফলে সরকারের অনেক ত্রাণ কর্মসূচী ও অন্যান্য কল্যানধর্মী কর্মকান্ডের বাইরে থেকে যায় বেশিরভাগ চরের মানুষ। কারন তাদের নেই স্থায়ি কোনো ঠিকানা।
অন্যান্য নদ অববাহিকার থেকে পদ্মার বৃকে চরের সংখ্যা বেশি থাকায় এই সমস্যাটি এ অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি।
জীবিকা ব্যাহত
মাছ ধরা আর সামান্য কৃষি কাজ ছাড়া পদ্মা চরের বেশিরভাগ মানুষই জীবিকার মাধ্যম হিসেবে গবাদী পশু পালন করে থাকে। চরের প্রায় প্রতিটি পরিবারই গৃহপালিত পশু যেমন গরু, ছাগল আর মৃরগী পালন করে থাকে। গত বছর ভারত থেকে গরু আমদানী বন্ধ হওয়ার পর থেকে চরের বাসিন্দারা পশু পালনকে একটি লাভজনক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্তু এবারের বন্যার পানিতে বহু গবাদী পশু ভেসে যায়। কিছু পরিবার অবশ্য তাদের গবাদী পশুগুলো রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। তারা আশা করেছিল ঈদ উৎসবের সময় পশু বিক্রি করে তারা ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু কোভিড-১৯ সৃষ্ট লকডাউনে এবার কোরবানীর পশুর হাট বন্ধ ছিল। পরে অল্প সময়ের জন্য খুলে দেয়া হলেও দরিদ্র চরবাসীরা তাদের পশুর ন্যায্য মূল্য পায়নি।
বন্যায় সহায়-সম্বল হারানো চর জানাজাতের বাসিন্দারা এখন মূলত মাছ ধরে কোনো রকম দিনাতিপাত করছেন।
চর জানাজাতের স্থানীয় বাসিন্দা সিরাজ মাতবর বলেন, ‘নদীতে মাছ ধরে আমরা কোনো মতে পরিবারের জন্য সামান্য হলেও কিছুটা খাদ্যের যোগান দিতে পারছি’।
ঘরবাড়ি হারিয়ে পদ্মার চরের অনেক মানুষ এখন এভাবেই নৌকায় বসবাস করছে মাসের পর মাস
বন্যার তোড়ে ঘর হারানো অনেক চরবাসী পরিবার পরিজন নিয়ে এমনই নৌকায় বসবাস করেন দিনের পর দিন
নেই স্বাস্থ্যসেবা
মাদারীপুর, ফরিদপুর আর শরিয়তপুরের বিভিন্ন চরের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ এখনও লকডাউনে আটকে আছে। দুর্গত এসব চরে এ মুহুর্তে খাদ্য আর বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। কোভিড-১৯ এর আতংকের মধ্যেই দিনি দিন বাড়ছে পানিবাহিত রোগের আশংকা।
চর জানাজাতের বাসিন্দা বলেন, আমাদের এখানে আগে কয়েকটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে কিছুটা চিকিৎসাসেবা পাওয়া যেত। কিন্তু বন্যা আর কোভিড-১৯ এর কারনে সব স¦াস্থ্যকেন্দ্রগুলো বন্ধ রয়েছে। এখানে এখন কোনো চিকিৎসক নেই।
কোভিড-১৯ এর প্রকোপ থেকে বাঁচতে কোনো রকম সাবধানতা অবলম্বন করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে শরিয়তপুর জেলার অন্তর্গত জাজিরার বরকান্দিন সাাইদুল ব্যাপারী বলেন, বেঁচে থাকার জন্য আমরা এখন দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য সংগ্রাম করছি। কোনো ধরনের অসুস্থ্যতার জন্য ওষুধ জোগাড় করার চিন্তা এখন আমাদের কাছে একপ্রকার বিলাসীতা। যদি কোনো কারনে ভাইরাস আমাদেও আক্রান্ত করে তবে তা মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যান্তর নেই। আমরা জানি হয়ত আমরা এভাবেই মারা যাবো, কিন্তু আমাদের এরচেয়ে বেশি কি-ই বা করার আছে?’
জলমগ্ন জীবন
জুলাই মাসের শেষের সময় থেকে এখন অব্দি মাদারীপুর জেলার প্রায় সবগুলো চর এখন বন্যার পানিতে ডুবে রয়েছে। প্রতিবেদন তৈরির সময় এই প্রতিবেদক সরেজমিন ঘুরে এই পরিস্থিতি দেখতে পান এখানকার বহু চর জলমগ্ন, ঘরবাড়ি আস ফসল পানির নিচে। চরগুলোতে যেন কোনো প্রান নেই, নেই কোনো গাছপালা ও ফসলের ক্ষেতের চিহ্ন। বেশিরভাগ বাসিন্দারা আশ্রয়েল খোঁজে অন্যত্র চলে গেছেন অথবা অস্থায়িভাবে নৌকায় বসবাস করছেন। চরের পাশাপাশি নদী তীরের আশেপাশের গ্রামগুলোও বন্যার পানিতে নিমজ্জিত।
পদ্মার সামান্য ভাটিতে যেখানে পদ্মা ও মেঘনা নদীর সঙ্গমস্থল তার পাশেই শরিয়তপুর জেলার কিছু অংশ। সেখানকার প্রায় ৫০টি গ্রাম বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। নদীভাঙ্গনের ফলে জাজিরার বরকান্দি, দূর্গাহাট ও নাওডোবার বহু ফসলের ক্ষেত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ্য।
মাদারীপুরের উজানে ফরিদপুর জেলারও একই অবস্থা। সেখানে বন্যায় ১৮৪,৮৩৩ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ্য হওয়ার তথ্য পাওয়অ গেছে। পাশাপশি ৪,০১৭ হেক্টর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পদ্মায় ভেসে যাওয়া অনেক বাড়ির মধ্যে একটি
বন্যা প্রতিরোধ
কোভিড-১৯ মহামারীর মাঝে বন্যা – এ যেন মরার উপরে খরার ঘা’। যদিও বাংলাদেশের জন্য প্রতি বছর বন্যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তবে এবারের বন্যার সার্বিবক পরিস্থিতি অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অস্বাভাবিক।
অনেকের মতে, মানুষের বিভিন্ন ধরনের কর্মকান্ডের কারনেই এই ধরনের বিরুপ পরিস্থিতির জন্য হয়েছে। আমাদের নদী বিধৌত অঞ্চলে গাছপালা কেটে জঙ্গল পরিস্কার করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে একের পর এক ইটের ভাটা। নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন মহামারী আকার ধারণ করেছে। ইটের ভাটার মালিকরা ভালো ইট তৈরীর জন্য ভূমির উপরের দিকে মাটি তুলে ফেলছেন আর এর মাধ্যমে তারা দিনের পর দিন নদীর পাড়গুলো ধ্বংস করে চলেছেন।
অন্যদিকে সরকারও নদী ভাঙ্গন রোধে তেমন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছে না। আগে থেকেই কোনো রকম প্রতিরোধ মূলক কার্যক্রম হাতে না নিয়ে কেবল ভাঙ্গনের নময় তড়িঘড়ি করে এক ধরনের অস্থায়ি ব্যবস্থা নেয়াই যেন সরকারের কাজ। নদীভাঙ্গনের সময় সরকারের একমাত্র দৃশ্যমান কাজ হচ্ছে নদীর তীরে জিও ব্যাগ ফেলে কোনো রকমে ভাঙ্গন ঠেকানোর চেষ্টা। স্থানীয়দের মতে এ ধরনের অস্থায়ী কাজের মাধ্যমে কোনোভাবেই একটি দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার এ ব্যাপারে বলেন, নদী ভাঙ্গনের অন্যতম কারন হচ্ছে ড্রেজিং এবং এ সংক্রান্ত আরো অনেক অব্যবস্থাপনা।
পদ্মা নদীর দুই তীরে ভাঙ্গনের আরো একটি অন্যতম কারন হচ্ছে পদ্মা ব্রিজকে কেন্দ্র করে অব্যাহত ড্রেজিং কার্যক্রম। মুজিবুর রহমান হাওলাদার আরো বলেন, ড্রেজিং করে উত্তোলন করা বালু সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় না। যার ফলে নদীর এখানে সেখানে গড়ে ওঠে ছোট-বড় চর। এর ফলে নদীর প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। পদ্মা ব্রিজটি নদীর ঠিক মাঝ দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে । আর এর ফলেও নদী ভাঙ্গনে ব্রিজটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
২০২০ সালের বন্যায় ভেসে যাওয়া একটি বিল্ডিংয়ের চিত্র
অজয় কুন্ডু বাংলাদেশের মাদারীপুরে কর্মরত একজন সাংবাদিক
অনুবাদ: আরিক গিফার
well done Ajoy