পানি

উদ্ধার হচ্ছে বরিশালের খাল

অবহেলা আর অদূরদর্শী পরিকল্পনার অভাবে প্রাচীন শহর বরিশালের হারিয়ে যেতে বসা নৌ-পথগুলোকে আবারো সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এসব খাল-বিলকে যোগাযোগের উপযোগী করে গড়ে তোলার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে।
বাংলা
<p>Downtown Barisal [image by Joe Coyle]</p>

Downtown Barisal [image by Joe Coyle]

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ১১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ১০৬ কিলোমিটার উত্তরে দেশের প্রাচীনতম শহর বরিশালের অবস্থান। সমুদ্র সমতল থেকে মাত্র ২.৫ মিটার উচ্চতায় থাকা ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের এই শহরের জনসংখ্যা ৫০০,০০০। ভৌগলিকভাবে কিছুটা নি¤œাঞ্চল এই জেলাটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। শহরটি একসময় বিখ্যাত ছিল এখানকার খাল-বিলের জন্য। বরিশাল নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি কথা হচ্ছে, ‘ধান-নদী-খাল, এই তিনে বরিশাল’।

তবে এটি এখন শুধুই অতীত। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বিপুল জনসংখ্যার চাপ আর দূর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারনে এখানকার যোগাযোগের এক সময়য়ের অন্যতম মাধ্যম এসব নৌ-পথ আজ একেবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে।

তবে আশার কথা ধ্বনিত হচ্ছে এখন চারপাশে, নিজের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পেতে জোর কাজ শুরু করেছে বরিশাল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। শহরটিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে অর্থাৎ অতীতের সব নদী ও খালসহ সব ধরনের নৌ-পথগুলোকে আবারো বাঁচিয়ে তুলতে নতুন একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। গত বছর থেকে শুরু হওয়া পনের বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের ব্যয় নির্ধারন করা হয়েছে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ইউরো (৭৪.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এর মধ্যে বৈদেশিক সহয়তার পরিমান ৩০ মিলিয়ন ইউরো (৩১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), অনুদান আকারে দিয়েছে জার্মানীর কেএফডব্লিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। আর বাকি অর্থের যোগান দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।

বাংলাদেশে কর্মরত সাংবাদিক আবু সিদ্দিক এ বিষয়টি নিয়ে বরিশাল নগরীর নগরপিতা (মেয়র) আহসান হাবিব খানের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন।

আবু সিদ্দিক (এএস): এই শহরের জলাভূমিগুলোর রক্ষার ক্ষেত্রে মূলত কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে?

আহসান হাবিব কামাল (এএইচকে): আপনি জানেন যে, বরিশাল শহরটি প্রচুর খাল, নদী এবং অন্যান্য জলাভূমি  (যেমন  – পুকুর) দ্বারা পূর্ণ। এখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে এসব প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর সুরক্ষা ও সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে এসব জলাভূমির বেশিরভাগগুই নানা প্রক্রিয়ায় দখল করে নিয়েছে সমাজের বিত্তশালী লোকজন, আর অন্যদিকে হতদরিদ্র কিছু জনগোষ্ঠী যাদের আসলে থাকার কোনো জায়গা নেই। আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে যে কোনো উপায়ে এসব জলাভূমিকে দখলমুক্ত করা এবং একইসাথে দরিদ্র যারা এই জলাভূমি দখল করে নিজেদের আবাসস্থল গড়ে তুলেছিল তাদের পূনর্বাসন নিশ্চিত করা।

এর মধ্য দিয়ে সব ধরনের নৌ-যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরূদ্ধারের পাশাপাশি সড়কপথে চাপ কমবে বলে আমরা আশা করছি। একই সাথে এসব জলাভূমি বর্ষা মৌসুমে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাকৃতিক নালা হিসেবেও কাজ করবে। উপরন্তু এই প্রকল্পের আওতায় আমরা খালগুলোকে জলের উৎস, বৃষ্টির জল অপসারণ, মাছ চাষ, সেচ এমনকি জলবায়ু ব্যবস্থাপনায়র কাজেও ব্যবহার করবো।

সাগরদাড়ি খালটিকে কিন্তু এমনই একটি পর্যবেক্ষণ প্রকল্প হিসেবে উন্নয়ন করা হচ্ছে। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই খাল থেকে সব ধরনের বর্জ্য সরাবরাহ ড্রেন অপসারণ করা হচ্ছে। এর চারপাশ দিয়ে পথচারী ও সাইকেল আরোহী চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মান করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এই খালের উপরে নির্মিত সবগুলো সেতু ও কালভার্ট সংস্কার করা হচ্ছে যাতে খালে সব ধরনের নৌ-যান, যেমন নৌকা ও ট্রলার স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারে।

এএস: এই প্রকল্পের আওতায় ঠিক কী ধরনের নৌ-পথ পরিকল্পনা হচ্ছে সে বিষয়ে বিস্তারিত বলুন।

এএইচকে: আমরা মূলত বরিশাল শহরের ভিতরে থাকা ৪৬টি খাল নিয়ে কাজ করবো। এই খালগুলো আসলে অত্যন্ত পুরাতন এবং শহরের পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রাকৃতিক ড্রেন হিসেবে কাজ করে।

প্রকল্পের নকশা অনুযায়ি, শহরের পুনরুদ্ধার ও সংস্কার করা নৌ-পথগুলোতে সব মিলিয়ে সাতটি ট্রন্সফার স্টেশন নির্মান করা হবে। এসব স্টেশন শহরের সড়ক পথের সাথে খুব ভালোভাবে সংযুক্ত থাকবে। একাজটি করার জন্য আমাদের আসলে আরো বেশ কিছু রাস্তাও তৈরি করতে হবে।

এএস: এই প্রকল্পটি ২০১৫ সালে অনুমোদন করা হয়েছিল। তখন থেকে এই পর্যন্ত কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?

এএইচকে: এখন পর্যন্ত আমরা কীর্তণখোলা নদীর দুই পাশে দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে থাকা সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করেছি। কিন্তু এখনও প্রচুর কাজ করার বাকি। আগামী দুই বছরের মধ্যে আমরা এই নদীর দুই পাশ থেকে সব ধরনের অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করতে সক্ষম হবো বলে আশা করছি। আমরা মনে করছি এর মাধ্যমে কীর্তণখোলার আশাপাশের সব খালগুলোকে নৌ চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলা যাবে।

এএস: শোনা যাচ্ছে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি ও চাপ আসছে বিভিন্ন মহল থেকে যাতে সদর রোডসহ শহরের অন্যান্য এলাকার অবৈধভাবে নির্মিত সুউচ্চ ভবনগুলোকে সুরক্ষা করা হয়?

এএইচকে: আসলে সত্যি কথা বলতে কি, এই মহাপরিকল্পনার কারনে অসংখ্য সুবিধাভোগী মানুষ ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। তাই বলা যায় এটি অবশ্যই এই ধরনের ব্যক্তিবর্গের কাছে মোটেও আকাক্সিক্ষত নয়। কিন্তু এদের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য তো আর আমরা আমাদের জনমুখী এই পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে পারি না! কারন এই মহাপরিকল্পনা এই শহরে বসবাসকারী প্রত্যেকটি নাগরিকের সুবিধার জন্যই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আমরা এই কার্যক্রম বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসনসহ শহরের তরুণ প্রজন্মকে সংযুক্ত করেছি। এর ফলে আমরা আশা করছি শহরের সাধারন মানুষের মধ্যে এই উন্নয়ন কর্মকান্ডের সুবিধার বিষয়টি তুলে ধরা যায়। কারণ আমরা মনে করি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে যথেষ্ট জনসচেতনতা প্রয়োজন। আমরা এরই মধ্যে নগরীর অধিবাসীদেরকে আবর্জণা ফেলে এখানকার পুকুরগুলো ভরাট না করার জন্য আহ্বান জানিয়েছি এবং এ থেকে প্রচুর ইতিবাচক সাড়াও পেয়েছি।

আমাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিকটি হচ্ছে জনগন এখন বুঝতে পারছে যে এটি একটি উন্নয়নমূলক কাজ যা তাদের  কাজ করছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বরিশাল নগরীর নি¤œাঞ্চলগুলো বন্যার কারনে প্লাবিত হয়। কিন্তু গত বছর শহরের ড্রেন বা নালাগুলো পরিস্কার থাকায় বৃষ্টির পানি খুব সহজেই সরে যেতে পেরেছে কারন আমরা বর্ষা মৌসুমের আগেই প্রচুর খাল ও পুকুর পূনঃখনন করেছি। এগুলো করা হয়েছে এই প্রকল্পেরই আওতায়। আমরা মনে করি এই পদক্ষেপের কারণে ভবিষ্যতে নগরীতে জলাবদ্ধতাও দুর হবে। মানুষ এটি বুঝতে পারছে যে এটি অত্যন্ত ফলপ্রসু।

এএস: এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কি কোনো ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে?

এএইচকে: দেখুন, আমাদের প্রকল্পের কাজে উৎসাহিত হয়ে বরিশাল জেলার জেলা প্রশাসক মহোদয় একটি ফেসবুক পেজ চালু করেছেন। গ্রুপটির নাম বরিশাল – সমস্যা ও সম্ভাবনা (Barisal – Problems & Prospect)। এখানকার নাগরিকদের এই উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহন বাড়াতেই এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নগরবাসী, বিশেষ করে, তরুন প্রজন্মের অনেকেই নিয়মিত এখানে তাদের মতামত প্রদান করছে।

শুধু তাই নয়, বরিশাল জেলার ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ব্রজমোহন কলেজ। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি। সম্প্রতি ব্রজমোহন কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা মিলে একটি কর্মসূচি পালন করেছে। তারা স্থানীয় জনগনকে উদ্বুদ্ধ করে নগরীর বিভিন্ন খালে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচারনা করেছে। এর একটিই অর্থ – আমাদের জনগন এখন এই মহাপরিকল্পনা নিয়ে অনেক উৎসাহী। এতে তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে আমি মনে করি।

 

আবু সিদ্দিক ঢাকায় কর্মরত একজন সাংবাদিক। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে ই-মেইল করুন – [email protected]