জলবায়ু

ক্ষুদে বার্তায় সতর্ক করে ভূমিধ্বসের হাত থেকে প্রানহানী রোধ করছে বাংলাদেশ

মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তাকে (এসএমএস) আগাম সতর্ক সংকেত হিসেবে প্রথম বারের মতো কাজে লাগিয়ে পার্বত্য এলাকার মানুষকে প্রানহানীর হাত থেকে রক্ষা করতে সফল হয়েছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পাহাড়ী অঞ্চলগুলোতে আকষ্মিক পাহাড় ধ্বসের ঘটনা বেড়েই চলেছে
বাংলা
<p>People cross a makeshift bridge made of bamboo. The bridge was built after floods destroyed part of the road.</p>

People cross a makeshift bridge made of bamboo. The bridge was built after floods destroyed part of the road.

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় বর্তমানে পাহাড় বা ভূমিধ্বস একটি নৈমিত্তিক প্রাকৃতিক দূর্যোগে পরিণত হয়েছে। তবে এবার পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধ্বস আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে কয়েকশ’ মানুষের প্রানহানী রোধ করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।

এই ধরনের সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় আবহাওয়া দপ্তরগুলো বৃষ্টিপাতের পরিমান পর্যালোচনা করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে সম্ভাব্য ভূমিধ্বসের অনেক আগেই সাধারন মানুষকে সতর্ক করে থাকে। ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দশ জন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে যারা তাৎক্ষণিকভাবে করণীয় নির্ধারণ করেন এবং সম্ভাব্য বিপজ্জনক স্থান থেকে দ্রুত সাধারন মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহন করেন।

এখন পর্যন্ত দেশের দু’টি জেলায় চারটি স্টেশন এই উদ্দেশ্যে স্থাপন করা হয়েছে বলে দ্যথার্ডপোল.নেটকে জানান বাংলাদেশ ভূ-তাত্বিক জরিপ বিভাগ বা জিওলজিক্যাল সার্ভে অব বাংলাদেশ’র (জিএসবি) মহাপরিচালক ড. মো. নেহাল উদ্দিন। বিদেশী সংস্থা নরওয়েজিয়ান জিওটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় জিএসবি বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিধ্বস ও ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে কাজ করে আসছে। পাশাপাশি এই সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যার কারনে ক্ষতিগ্রস্থ্য বাঁধ চিহ্নিত করার কাজও করে থাকে।

সৌর শক্তির মাধ্যমে চালিত স্বয়ংক্রিয় এসব স্টেশন বৃষ্টিপাতের মাত্রা পর্যালোচনা করে থাকে। এধরনের দু’টি স্টেশন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম ও উপকূলীয় মৎস্য বন্দর কক্সবাজারের পাশে টেকনাফ জেলায় স্থাপন করা হয়েছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ বসবাস করে যারা ভূমিধ্বসের হুমকির মধ্যে রয়েছে। গ্রীষ্মম-লীয় মৌসুমী জলবায়ুর কারনে এসব অঞ্চলে মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৯০ শতাংশই জুন ও অক্টোবরের মধ্যবর্তী সময়ে ঘটে থাকে।

এই দু’টি স্টেশন নিয়মিতভাবে একটি অনলাইন তথ্য ভান্ডারে (ডেটাবেজ) স্থানীয় বৃষ্টিপাতের তথ্য সরাবরাহ করে থাকে যা তাৎক্ষণিকভাবে পর্যালোচনা করে ভূমিধ্বস সতর্কীকরনের কাজে ব্যবহার করা হয়। পাশাপাশি এই তথ্য দিয়ে বন্যার পূর্বাভাসও প্রচার করা হয়ে থাকে।

landslide early warning system SMS

জিএসবি এরই মধ্যে ভূমিধ্বসের সম্ভাবনা নির্ধারনে পাবর্ত্য অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের পরিমান ও ধরণ সম্পর্কে সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষন করে একটি ঝুঁকিপূর্ন মাত্রা নির্ধারণ করেছে। বৃষ্টিপাতের পরিমান ওই মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবহাওয়া স্টেশনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে ক্ষুদে বার্তা পাঠাতে শুরু করে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জিএসবি’র পরিচালক রেশাদ মো. একরাম আলি দ্যথার্ডপোল.নেটকে বলেন, আমাদের জরীপ  অনুযায়ী ভূমিধ্বসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বৃষ্টিপাতের মাত্রা হচ্ছে তিন ঘন্টার মধ্যে ১০০ মিলিমিটার, ২৪ ঘন্টায় ২০০ মিলিমিটার এবং তিন দিনে ৩৫০ মিলিমিটার।

এখন পর্যন্ত এই ব্যবস্থা খুব ভালোভাবে কাজ করছে বলে জানান রেশাদ। তার দল এখন পর্যন্ত তিনটি সতর্ক বার্তা পেয়েছে যার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাফে এক হাজারেরও বেশি মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছে।

অবশ্য এই ব্যবস্থাকে আরো কার্যকরী করে  গড়ে তোলার সুযোগ আছে বলে অনেকেই মনে করেন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত পাঁচটি ভূমিধ্বসের ঘটনায় ২০ জনের প্রানহানীর ঘটনা ঘটেছে। তবে এখন পর্যন্ত পার্বত্য এলাকার বান্দরবানে এ ধরনের কোনো স্টেশন স্থাপন করা হয়নি। অথচ দেশের তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান অন্যতম একটি ভূমিধ্বস প্রবন এলাকা। এই জেলাগুলোতে এখন সামান্য বৃষ্টিপাতের কারনেই ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটছে। পার্বত্য এলাকায় মানুষ এখন বিভিন্ন প্রয়োজনে অবৈধভাবে পাহাড়ের ঢাল কেটে মাটি নিয়ে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছে। ফলে বেড়েই চলেছে ভূমিধ্বসের ঘটনা। এই ক্ষেত্রে সতর্কীকরণ ব্যবস্থা অনেক সময়ই কাজে আসছে না।

বৃষ্টিপাতকে ভূমিধ্বসের মূল কারন হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও পার্বত্য এলাকায় নগরায়ন ও বনভূমি উজাড় এই ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

অনাস্থা

এদিকে ভূমিধ্বস সতর্কীকরণ ব্যবস্থাকে এখনও আস্থায় আনতে পারছেন না অনেকেই। গত ২৫ জুলাই, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলি হোসাইন ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং ভূমিধ্বসের একটি আগাম সতর্ক বার্তা পান। দ্যথার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, এরপরই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসকারী জনগণকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নেয়া হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও সেখানকার অনেককেই অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যাচ্ছিল না। কারন তারা সতর্ক বার্তাকে আমলে নিতে চাননি। এর কয়েক ঘন্টা পরেই মধ্যরাতে ভূমিধ্বসের ঘটনা ঘটে এবং পাহাড়ের পাদদেশ থাকা পাঁচটি কাঁচা বাড়ি পাহাড় ধ্বসে মাটির নিচে চলে যায়। এ ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয় এবং আরো চারজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহুর্তে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের ধরন অনেকটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। সম্প্রতি একটি বিষয় খুব লক্ষণীয় আর তা হচ্ছে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে ব্যাপক বৃষ্টিপাত। এর ফলে ভূমিধ্বসের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রানহানীসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি।

বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি দেশ যেটি সার্বক্ষনিকই বন্যা, সাইক্লোন, নদী ভাঙ্গন ও ভূমিধ্বসের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের হুমকির মধ্যে রয়েছে। ২০০৬ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় সবমিলিয়ে ভূমিধ্বসের ঘটনায় ২০০ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে কেবল ২০০৭ সালেই একটি ভূমিধ্বসের ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ১২৭।

অনুবাদ: নুসরাত জাহান