icon/64x64/regionalcooperation আঞ্চলিক সহযোগিতা

হিমবাহ সৃষ্ট বন্যা এখন থার্ডপোল দেশগুলোর জন্য বড় হুমকি

জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর হিমবাহ গলে গিয়ে গ্লেসিয়ার লেকগুলো এখন সম্প্রসারিত হয়ে উঠছে, সেই সঙ্গে থার্ডপোল এলাকার নিচু এলাকাগুলোতে বাড়িয়ে তুলছে ভয়াবহ বন্যার আশংকা

 

গত তিন দশকে তিব্বতীয় প্লেটো ও এর আশাপাশের সব পর্বতমালায় ধীরে ধীরে গ্লেসিয়ার লেক (হিমবাহ হৃদ) বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। মূলত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি কারনে হিমবাহ গলে যাচ্ছে, আর এর ফলে সম্প্রসারিত হচ্ছে এসব লেক (হিমবাহ হৃদ)। সম্প্রতি এক গবেষনায় এ তথ্য উঠে এসেছে । এর মাধ্যমে এই ভূখন্ডের নিচু এলাকাগুলোতে থাকা দেশগুলোতে ভায়াবহ বন্যাসহ মারাত্বক ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে।

এশিয়ার হিন্দুকুশ-হিমালয় অঞ্চলকে পৃথিবীর তৃতীয় মেরু বা থার্ডপোল বলা হয়ে থাকে কারন এই অঞ্চলে পৃথিবীর অন্য দুটি মেরুর পরেই সবচেয়ে বেশি বরফ স্থায়ীভাবে জমাটকৃত অবস্থায় রয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারনে এই বরফ আশংকাজনভাবে গলতে শুরু করেছে। যেহেতু বরফ গলে জলে রুপান্তরিত হয়,  তাই এখানকার হিমবাহ গলে ধীরে ধীরে হৃদ বা জলাধারে পরিণত হচ্ছে।

চাইনিজ একাডেমি অব সায়ন্সেস- এর ইন্সটিটিউট অব টিবেটান প্লেটোরিসার্স-এর গবেষকরা বিষয়টি নিয়ে পামির,  হিন্দুকুশ – কারাকোরাম,  হিমালয় এবং তিব্বতীয় প্লেটো এলাকায় প্রথমবার ব্যাপক গবেষনা পরিচালনা করেছে । এক্ষেত্রে তারা ভূমি ও স্যাটেলাইট থেকে চিত্র ধারন করে এখানকার হিমবাহগুলোর অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখেছে।

গ্লোবাল অ্যান্ড প্ল্যানেটারি চেঞ্জ জার্নালে প্রকাশিত নতুন এ গবেষনা প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে এ অঞ্চলে ভবিষ্যতে যে ব্যাপক বন্যাসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির আশংকা করা হচ্ছে তা এ গবেষনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

গবেষনায় দেখা গেছে থার্ডপোলে ১৯৯০ সালে গ্লেসিয়ার (হিমবাহ) লেকের সংখ্যা ছিল ৪,৬০২ যা ২০০০ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৪,৯৮১ তে। আর ২০১০ সালে এই লেকের সংখ্যা গিয়ে পৌছেছে ৫,৭০১ তে। আর এসব লেক গড়ে প্রতিবছর ৩১ সেমি করে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক জরীপে এ চিত্র পাওয়া যায়।

গ্লেসিয়ার লেক সম্প্রসারনের কারন হিসেবে বরফ গলে যাওয়া এবং অতিবৃষ্টিকে চিহ্নিত করা হয়েছে । এছাড়া এখানকার স্থায়ী জমাটকৃত ভূমি, যাকে বলা হয় পারমাফ্রস্ট, তা ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়ে বরফে পরিণত হচ্ছে । লেক সম্প্রসারনের এটিও একটি কারন হতে পারে।

সবচেয়ে বেশি লেক সম্প্রসারনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ ভূটান, এভারেষ্ট পর্বতমালা ও তার চারপাশে এবং নেপালের পশ্চিমাংশে । এখানে বরফ গলার হার অত্যন্ত বেশি । এবছরের প্রথম দিকে প্রকাশিত চীনের সেকেন্ড গ্লেসিয়ার ইনভেন্টরির তথ্য অনুযায়ি থার্ডপোলে ১৯৭০ সালের পর থেকে গ্লেসিয়ার হ্রাস পাওয়ার হার ১৮ শতাংশ । মোটাদাগে এসব লেকের অবস্থান ব্রক্ষ্মপুত্র (৩৯%),  ইন্দাস (২৮%) এবং আমুদারিয়া  (১০%)  বেসিনে,  যেখানে সাধারনত স্বল্প তুষারপাত হয় এবং মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমান ও অনেক বেশি।

বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও হিমবাহ গলে যাওয়ার মাত্রা বিবেচনা করে এই গবেষনার ফলাফলকে সঠিক বলেই বিবেচনা করছেন ইন্সটিটিউট অব টিবেটান প্লেটোরিসার্চের সহযোগি অধ্যাপক ঝ্যাং গুয়োকিং । তিনি এই গবেষনাপত্রের মূল লেখক । দ্যথার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, আমাদের গবেষক দলকে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি বিস্মিত করেছে তাহলো কারাকোরাম রেঞ্জের গ্লেসিয়ার লেকের ধরণ । তিনি বলেন, পাকিস্তান,  ভারত ও চীন সীমান্ত এলাকায়ও এসব লেকের পরিমান বেড়েছে । যদিও অনেক গবেষকই বলছেন এসব এলাকার গ্লেসিয়ার লেকগুলো সম্প্রসারিত হচ্ছে কিংবা স্থির অবস্থায় আছে।

একই দৃশ্য

এই গবেষণার বাইরে আরো বেশ কিছু গবেষনায়ও একই ধরনের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে । বিশেষ করে নেপাল ও ভূটানের চিত্র অনেকটাই এক ধরনের । এখানকার ইমজা লেকের জল প্রতি বছর ৪৭ মিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে । ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে মাউন্ট কোমোলাংমায় রংবুক গ্লেসিয়ার ১৩ গুন বৃদ্ধি পেয়েছে।

নেপালের কাঠমান্ডুতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্ট (আইসিআইএমওডি) – এর গবেষক প্রদীপ মূল গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ নিয়ে গবেষনা করছেন । তার মতে থার্ডপোল অঞ্চলে গ্লেসিয়ার লেকের পরিমান যা ভাবা হচ্ছে তার চেয়েও অনেক বেশি হতে পারে।

এ বছরের শেষ দিকে তার নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষনার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে।এই দলটিও ল্যান্ডস্যাট ডেটা ব্যবহার করে গবেষণা পরিচালনা করেছে । চীনের গবেষকরা গ্লেসিয়ার লেকের অবস্থান গ্লেসিয়ারের কেন্দ্রভাগের ১০ কিমি এলাকার মধ্যেই চিহ্নিত করছেন । তবে আইসিআইএমওডি-এর গবেষনা দল লেকের অবস্থান আরো দুরে বলে মনে করছেন।

আইসিআইএমওডি-র অন্য একটি গবেষনায় বলা হয়েছিল থার্ডপোল এলাকায় সব মিলিয়ে ৮ হাজার গ্লেসিয়ার লেক রয়েছে । যার মধ্যে ১,৪০০ লেকের অবস্থানই হচ্ছে নেপালে ।

ধেয়ে আসছে বিপদ

গ্লেসিয়ার লেকগুলো ক্রমেই ধ্বংস ডেকে আনছে । একটি লেক ভেঙ্গে পড়ার অর্থ অত্যন্ত ভয়াবহ!  লেকের দেয়াল ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে প্রচন্ড গতিতে ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়বে (গ্লেসিয়ার সৃষ্ট ধ্বংসাবশেষকে বলা হয় মোরেইন), এর ফলে প্রচন্ড গতিতে ধেয়ে আসবে বন্যা, সেই সঙ্গে যুক্ত হবে কাঁদামাটি আর পাথর যা ছড়িয়ে যেতে পারে ৯০ কি. মি.  এলাকা পর্যন্ত । এর ফলে বিস্তীর্ন এলাকার বাড়িঘর ও ফসলী জমি জল আর কাঁদামাটির নিচে প্রায় ১৫ মিটার পর্যন্ত তলিয়ে যেতে পারে । এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ,  একটি সম্পূর্ন প্রজন্ম হারাতে পারে ফসলী জমি । বরফ গলে যাওয়ার যে গতি অব্যাহত আছে,  তাতে এখন একটি প্রশ্নই আমাদের মাথায় রেখে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করা উচিত, আর তা হচ্ছে কখন ঘটবে এই বিপর্যয়?

১৯৩০ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত গ্লেসিয়ার লেক বিষ্ফোরনের ঘটনা ঘটেছে ৫০ টি। দ্যথার্ডপোল.নেটকে একথা জানান প্রদীপ মূল । তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে ১৯৮১ সালে । সেসময় সিরেনমাচো গ্লেসিয়ার লেক থেকে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয় যার ফলে ২২০ জন মানুষের প্রানহানী ঘটে, গুড়িয়ে যায় চীন-নেপাল মৈত্রি সেতু । এ ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল তিন মিলিয়ন মার্কিন ডলার । এ মুহুর্তে স্যাটেলাইটে ধারণকৃত চিত্রে দেখা যাচ্ছে এই লেকটি পরিপূর্ণ  অবস্থায় রয়েছে । যে কোনো মুহুর্তে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অথবা ভূমিকম্পে এই লেকে বিষ্ফোরণ ঘটতে পারে।

হিমালয়ে গ্লেসিয়াল লেক আউট বার্ষ্ট ফ্লাড (GLOFs) নিয়ে আরো বিস্তর গবেষনার তাগিদ দিয়েছেন অধ্যাপক ঝ্যাং। সম্প্রতি নেপালে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর এই বিষয়টি আরো প্রবল হয়ে উঠেছে। তবে ভূমিকম্পের পরপরই গবেষকরা বেশ কিছু গ্লেসিয়াল লেক পরিদর্শন করেছেন।এ মুহুর্তে এসব লেক মোটামুটি আশংকামুক্ত রয়েছে বলে তারা মত দিয়েছেন।

চলতি বছর জুনের শেষদিকে ভারতে সৃষ্ট এক ভূমিকম্পে ভূটানে লেমথ্যাং স্যো গ্লেসিয়ার ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয় । এর ফলে ওই লেকের অববাহিকায় থাকা রাস্তা-ঘাট ও ফসলী জমি বন্যার পানিতে ভেসে যায় । এক্ষেত্রে সরকার পরিচালিত ব্যাপক সচেতনতা কর্মসূচি এবং পূর্বাভাসসমূহ ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করেছিল, বিশেষ করে এর ফলে কোনো প্রানহানীর ঘটনা ঘটেনি, যদিও বেশ কিছু মানুষকে জলবন্দী থাকতে হয়েছিল এবং পুনাসাংচু হাইড্রো পাওয়ার ড্যামের (জলবিদ্যুত প্রকল্পের) আশপাশ থেকে আরো বেশ কিছু মানুষকে জরুরী ভিত্তিতে স্থানান্তর করতে হয়েছিল।

অনুবাদ : নুসরাত জাহান

একটি মন্তব্য যোগ করুন

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.