পানি

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফর: তিস্তা নিয়ে কেবলই আশার বাণী

নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক আর আঞ্চলিক যোগাযোগ ইস্যুতে ঢাকায় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও তিস্তার জল বন্টন ইস্যুতে ফলপ্রসু কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি।
বাংলা
<p>India&#8217;s Prime Minister Narendra Modi (top left) and Bangladesh&#8217;s Prime Minister Sheikh Hasina witness the exchange of agreements between the two countries during Modi&#8217;s recent visit to Dhaka (Image by Press Information Bureau, Government of India)</p>

India’s Prime Minister Narendra Modi (top left) and Bangladesh’s Prime Minister Sheikh Hasina witness the exchange of agreements between the two countries during Modi’s recent visit to Dhaka (Image by Press Information Bureau, Government of India)

তিস্তার জল বন্টন চুক্তির মতো দীর্ঘ প্রত্যাশিত ইস্যুতে এবার যে কিছু হবে না, তা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের প্রায় এক সপ্তাহ আগেই পরিস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু এনিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষনা না থাকায় বাংলাদেশে যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হয়েছে সে বিষয়টি বেশ পরিস্কার হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কেবল আশার বাণী নয়, বরং একটি সুস্পষ্ট ঘোষনা আশা করেছিল। আর এ নিয়ে এদেশের মানুষের উদ্বেগের বিষয়ে যথেষ্ট ওয়াকিবহালও ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে তিস্তা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি নদী। সিকিমে হিমালয়ে জন্ম নেয়া এই নদীটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের  প্রায় ১৪ শতাংশ কৃষি জমিতে সেচের জলের যোগান আসে এই নদী থেকেই।

হতাশার বিষয়টি বেশ পরিস্কার করেই বললেন অধ্যাপক আইনুন নিশাত। জানতে চাইলে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের সাবেক সদস্য ও ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস আইনুন নিশাত দ্যথার্ডপোল.নেটকে  বলেন, ‘আমার মতে বাংলাদেশের আমলাদের একটি বড় দূর্বলতা হলো তারা দ্বিপক্ষিয় আলোচনার আগে ভালোভাবে প্রস্তুতি নেন না। তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে ছিট মহল বিনিময় চুক্তিটি ১৯৭৪ সালে সই হয়। অথচ এই চুক্তির বাস্তবায়ন হতে লেগে গেল ৪১ বছর। সুতরাং এটি আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তাঁর মতে, এদেশের সাধারণ মানুষ মনে করেছিল নরেন্দ্র মোদীর এই সফরে অন্তত তিস্তা চুক্তিটি সই হবে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে এটি আরো অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য পিছিয়ে গেল।’

চলতি মাসে নরেন্দ্র মোদীর সফরের সময় ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হয়। তবে এসব চুক্তি নিয়ে খুশি নন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট ল’ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাঁর মতে, এটি আসলে ‘নতুন বোতলে পুরোনো মদ’ (ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বোটল) রাখার মতো একটি বিষয়। এ ব্যাপারে দ্যথার্ডপোল.নেটকে তিনি বলেন, ‘ভারতের পক্ষ থেকে অনেক বিষয়ইে প্রতিশ্রুতি ছিল। অথচ এর কোনোটিই তারা রক্ষা করেনি। এমনকি তিস্তার জল বন্টন চুক্তির মতো একটি নিষ্পন্ন বিষয়েরও কোনো সমাধান হলো না।’

তিনি বলেন, ‘আমরা যদি যোগ্য হিস্যা অনুযায়ি জল না পাই, আমাদের পক্ষে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবেলা করাটা দুষ্কর হয়ে পড়বে। এখন বাংলাদেশের উচিত বিষয়টি নিয়ে কেবল দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা সীমিত না রেখে আঞ্চলিক পর্যায়ে আলোচনার পথ তৈরি করা।’ এক্ষেত্রে তিনি চীনকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দেন।

এদিকে ঢাকা সফরের সময় এক বিবৃতীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘জল বন্টনের বিষয়টি সব কিছুর উর্ধ্বে, এটি একটি মানবিক ব্যাপার। দু’দেশের মধ্যে বয়ে চলা এসব নদী হতে পারে আমাদের সম্পর্কের এক সেতুবন্ধন। এই নদী কোনোভাবেই আমাদের দু’দেশের মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হতে পারে না।’ তিনি তিস্তা ও ফেণী নদীর (ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে উৎপন্ন) জল বন্টন নিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব একটি সমঝোতায় পৌছানোর ব্যাপারে তার দেশের পক্ষ থেকে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

তিনি বলেন, ‘ভারতের রাজ্য সরকারের সমর্থন নিয়ে আমরা তিস্তা ও ফেণী নদীর জল বন্টন নিয়ে একটি সম্মানজনক সমাধানে পৌছাতে দৃঢ়ভাবে আশাবাদী। একইসাথে আমাদের নদীগুলোকে আরো পরিস্কার করে গড়ে তুলতে আমরা দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করতে চাই।’ ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এসময় ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও উপস্থিত ছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে মমতা ব্যানার্জীর ঢাকা সফরের সময় দু’পক্ষের মধ্যে তিস্তা চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে এক ধরনের আশাবাদ তৈরি হয়েছিল।

প্রায় তিন বছর আগে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় তিস্তার জল বন্টন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল। চুক্তি অনুযায়ি দুেেশর মধ্যে তিস্তার জল সমানভাবে বন্টনের কথা ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর আপত্তি মুখে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তির অবস্থান থেকে সরে আসে।

এ ব্যাপারে তিস্তা রক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ফরিদুল ইসলাম ফিরোজ বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে চুক্তি সইয়ের বিষয়টি এখন বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। এটি একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। তিস্তার পাড়ে বসবাসকারী ফিরোজের মতে, ঢাকায় নরেন্দ্র মোদীর সফরের পর আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন হয়ত দেখা যাবে। তবে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে সাধারণ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এনিয়ে ইতিবাচক কোনো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ তাদের কাছে এটি এখন একটি রাজনৈতিক ইস্যু।’ নদীতে জলের অবস্থা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গত বছর বৃষ্টির কারনে অল্প নদীতে কিছু জল থাকলেও এবারের চিত্র ঠিক তার উল্টো। এখন যে কেউ পায়ে হেঁটে তিস্তার এপার থেকে ওপারে যেতে পারেন।’

এদিকে সরকারও তিস্তা নিয়ে খুব একটা তোড়জোড় করতে চাইছে না। নরেন্দ্র মোদীর সফরের একদিন আগে ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ বলেন, তিস্তা নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। তিনি এনিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানের পৌছতে জনগণকে কিছুটা ধৈর্য্য ধরার আহ্বান জানান।

অন্যান্য নদীসমূহ

নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতীতে বলা হয়, মানু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতি, ধরলা ও দুধকুমারসহ অন্যান্য যৌথ নদী নিয়ে কারিগরি পর্যায়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। এব্যাপারে দু’দেশের কর্মকর্তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ভারতের হিমালয় অঞ্চলের নদীসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ যাতে কোনো ভাবেই ক্ষতিগ্রস্থ না হয় সে ব্যাপারেও আশ্বস্ত করেছেন নরেন্দ্র মোদী। বিবৃতিতে তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে মণিপুরে টিপাইমুখ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দু’টি জলের অভাবে শুকিয়ে যেতে পারে। তবে ভারত এসব বিষয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহন করবে না যার ফলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এদিকে বাংলাদেশের পদ্মা নদীতে একটি ব্যারাজ (বাঁধ) স্থাপনের লক্ষ্যে শেখ হাসিনা ভারতের সহযোগীতা আশা করেন। জবাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।

অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল, সড়ক ও নৌ যোগাযোগের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয় ১৯৪৭ এর আগেই। সেসময় ভারতীয় উপমহাদেশে পাকিস্তান ও ভারত নামে দু’টি দেশই ছিল। ১৯৬৫ সালে এ দু’টি দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে সব ধরনের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থগিত হয়ে যায়। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর কেবল নৌ যোগাযোগ চালু করা হয়।

চার দশক ধরে যোগাযোগের এই পরম্পরার বিষয়টি উল্লেখ করে মোদী তার এক বক্তৃতায় বলেন, “আমরা এই দু’টি জাতি বহুদিন ধরে কেবল ‘পাশিপাশি’ চলছি, এখন থেকে আমরা একজন অপরজনকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাবো। ”

ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এবারকার সফরের বিষয়টিকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। তাঁর এই সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে আঞ্চলিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিমান চুক্তি সই হয়েছে।

এসময় উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন। বিশেষ করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ব্যাপারে দু’পক্ষই ‘জিরো টলারেন্স’ প্রদর্শনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। পাশপাশি একটি ‘মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট এগ্রিমেন্ট’ (বহুমাত্রিক যোগাযোগ বিষয়ক চুক্তি) নিয়েও আলোচনা শুরু করার ক্ষেত্রে সম্মত হয় প্রতিবেশী দেশ দু’টি। এ বিষয়ে একটি টাস্ক ফোর্সও গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়। অপরদিকে আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রেও একটি মাইলফলক রচিত হয়েছে এবারের সফরে। বাংলাদেশ এরইমধ্যে এনিয়ে কাজও শুরু করেছে। গত ৭ জুন মোদীর সফরের পরপরই বাংলাদেশের কেবিনেটে আঞ্চলিক যোগাযোগ বিষয়ক একটি প্রস্তাব পাশ হয়।

আঞ্চলিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যৌথ নদীর ব্যবহার

নরেন্দ্র মোদীর ঢাকা সফরের সময় আভ্যন্তরীন নৌ ট্রানজিট ও বাণিজ্য বিষয়ক প্রটোকলের (পিআইডব্লিউটিটি) উপরে একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার (এসওপি) সই করা হয়। দু’দেশের নৌ যোগাযোগের রুট, বন্দরসহ অন্যান্য বিষয়ে এসওপিতে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। এর মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে নৌ রুট ব্যবহার করে পণ্য আনা-নেয়ার কাজ আরো সহজভাবে করা যাবে। তবে ভারতের ভিতর দিয়ে নেপাল ও ভূটানে পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঢাকার আরো একটি চুক্তি সই করতে হবে বলে জানান কর্মকর্তারা।

এসওপিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সব মিলিয়ে ১২টি বন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ হিসেবে ঘোষনা দেয়া হয়েছে যার ৬টি বাংলাদেশে আর বাকি ৬টি রয়েছে ভারতে। এই বন্দরগুলোতে দু’দেশের জাহাজ পন্য বোঝাই ও খালাস করতে পারবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়য়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব নদীতে ভালোভাবে জাহাজ পরিচালনার জন্য ৫.২ মিলিয়ন কিউবিক মিটার ড্রেজিং করতে হবে। এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পরিকল্পনা মন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তাফা কামাল বলেন, সরকার এসব নদীতে প্রতি মাসে ড্রেজিংয়ের পরিমান এবং কী পরিমান অর্থের প্রয়োজন হবে সে বিষয়ে একটি জরীপ পরিচালনা করবে। উল্লেখ্য, দু’দেশের সরকারই এই নদীগুলোতে নাব্যতা বজায় রাখতে ড্রেজিং করে থাকে।